সিল্করুট

লুটের গঠন ও বিবর্তন

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন

জার্মানির ফুসেন শহরের এক লুট কারিগর। ছবি: ফুসেন বাভারিয়া

ষোলো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। জার্মানির অঙ্গরাজ্য বাভারিয়ার ছোট একটি গ্রাম ফুসেন। তাতে অসংখ্য কারখানা। নিবিষ্ট মনে কাজ করে চলেছেন কারিগররা। পরিপূর্ণ দক্ষতা নৈপুণ্যের সঙ্গে একের পর এক তারা বানিয়ে চলেছেন অনিন্দ্যসুন্দর সব লুট সাধকের একাগ্রতা নিয়ে তারা কাজ করছেন। এমনটাই ছিল তৎকালীন ফুসেনের দৈনন্দিন চিত্র। ইউরোপের লুট নির্মাণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল ছোট গ্রামটি। ব্যাঙের ছাতার মতো গ্রামটির সর্বত্র গজিয়ে উঠেছিল লুট নির্মাণের কারখানা। ফলে লুট নির্মাতাদের একটি গিল্ড প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নির্মাতাদের নিয়ন্ত্রণ করা তাদের কাজকে সুসংগঠিত করা ছিল গিল্ডের দায়িত্ব। ফুসেন শহরে সর্বোচ্চ ২০টি লুট নির্মাণের কারখানা থাকতে পারবে বলে গিল্ড আইন জারি করে। লুটের ইতিহাসে আইন অনেক বড় প্রভাব ফেলেছিল। ফুসেন ছাড়তে বাধ্য হন অনেক নির্মাতা। প্রথমে তারা বাভারিয়ার আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। তারপর তারা ভায়া ক্লডিয়া অগাস্টা (রোমান শাসনামলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ) ধরে ভেনিসে চলে যান। দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে একসময় তারা বোলোগনা পদুয়ায় উপস্থিত হন। ইতালির উত্তর প্রান্তের দুটি শহর। সতেরো আঠারো শতকে শহর দুটি লুট নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। তৎকালীন প্রায় সব দক্ষ লুট নির্মাতা মূলত বাভারিয়া থেকেই এসেছিলেন।

ইউরোপে লুটের প্রথম আবির্ভাবের পর থেকে পর্যন্ত বাদ্যযন্ত্রটি নানা ধরনের বিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে। পরিবর্তনগুলোর অধিকাংশই হয়েছে তারের দৈর্ঘ্য, সংখ্যা গুচ্ছকে কেন্দ্র করে। মধ্যযুগে নির্মিত লুটগুলোতে তারের চারটি গুচ্ছ ছিল। একপর্যায়ে সংখ্যাটি তেরোতে উন্নীত হয়। চৌদ্দ শতকে নির্মিত লুটের শরীরে গোলাপ ফুলের একটি বা দুটি নকশা থাকত। এর পেগবক্সটি ছিল বাঁকানো। ঘাড় ছিল অধিকতর লম্বা। ১৩৭২ সালের একটি নথিতে প্রথম লুটের উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি ছিল লুট শেখার জন্য শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তিপত্র। তা থেকে প্রমাণিত হয় যে চৌদ্দ শতকের একেবারে গোড়া থেকেই ইউরোপে লুট স্কুলের অস্তিত্ব ছিল। পনেরো শতকে লুটে তারের আরেকটি গুচ্ছ সংযোজিত হয়। সময় চার পাঁচ গুচ্ছের তারবিশিষ্ট লুটের সহাবস্থান ছিল। রেনেসাঁকালে পলিফোনি (একই সময়ে একাধিক স্বয়ংসম্পূর্ণ সুরের সমবায়) উত্থান ঘটে। তখন লুটে তারের ষষ্ঠ গুচ্ছটি যুক্ত হয়। সে সময় কাঠের নয় থেকে তেরোটি টুকরোর সমন্বয়ে লুটের মূল কাঠামোটি তৈরি হতো। এক্ষেত্রে সাধারণত ম্যাপল গাছের কাঠ ব্যবহার করা হতো। তার ওপর খোদাই করা থাকত গোলাপ ফুলের সুদৃশ্য নকশা। রেনেসাঁকালে লুট বাদকরা প্লেকট্রাম-এর (লুট বাজানোর জন্য ব্যবহূত পাতলা কাঠের টুকরো) পরিবর্তে সরাসরি আঙুল দিয়ে লুট বাজানো শুরু করেন। এতে করে তাদের পক্ষে একই বাদ্যযন্ত্রে একাধিক সুরের দ্যোতনা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিল। ষোলো শতকের সমাপ্তিলগ্নে তারের সাতটি গুচ্ছবিশিষ্ট লুট জনপ্রিয়তা লাভ করে। সে সময় আট দশ গুচ্ছবিশিষ্ট লুটও বর্তমান ছিল।

লুটের গঠন নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। লুট অনেকটাই গিটারের মতো। কাঠের পাতলা টুকরো দিয়ে তৈরি এর ফাঁপা শরীর। লুটের শরীর গোলাকার। এর ফাঁপা অংশটি বেশ গভীর। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে বাদ্যযন্ত্রটি থেকে নির্গত সুর বেশ স্বতন্ত্র। লুটের শরীরের সমতল অংশটিকে সাউন্ডবোর্ড বলা হয়। এতে সুনির্দিষ্ট আকৃতিতে কাটা একটি অংশ আছে। এটি লুট থেকে নির্গত শব্দকে প্রতিধ্বনিত করে এবং বাদ্যযন্ত্রটির সারা শরীরে শব্দটি ছড়িয়ে দেয়। লুটের ফিঙ্গারবোর্ড ফ্রেটগুলো এর ঘাড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ঘাড়ের শেষ প্রান্তে পেগবক্সের অবস্থান। পেগ-এর (কীলক) মাধ্যমে লুটের তারগুলো পেগবক্সে আটকে থাকে। পেগগুলোকে ঘোরানোর মাধ্যমে বাদকরা তারগুলোকে টান টান বা ঢিলা করেন। এভাবে লুটের টিউনিং করা হয়।

লুটের তারগুলোর কাজ গিটারের তারের মতোই। তারা পেগবক্স থেকে লুটের কাঁধ বেয়ে নেমে এসে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তারগুলো লুটের নিচের দিকে অবস্থিত ব্রিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

ভেনিস আফ্রিকার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক লুট নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। লুট নির্মাণের কাঁচামাল প্রধানত আফ্রিকা থেকেই আসত। এক্ষেত্রে আবলুস কাঠ, হাতির দাঁত, স্নেইক উড, রোজ উড প্রভৃতি ছিল প্রধান কাঁচামাল। সময় টিফেনব্রুকার পরিবার (ভেনিসে লুট নির্মাণকারী গুরুত্বপূর্ণ পরিবারগুলোর মধ্যে একটি) লুট নির্মাণের একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তারা কাঠের ত্রিশটিরও বেশি টুকরো দিয়ে লুট তৈরি করতেন। অধিকন্তু তারা ম্যাপলের পরিবর্তে ইউ গাছের কাঠ ব্যবহার করতেন। তাদের অনুসরণে লুট নির্মাতাদের মধ্যে ইউ গাছের কাঠ জনপ্রিয়তা লাভ করে। রেনেসাঁ আমলের শেষ দিকেও লুট নির্মাণ নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। প্রথমে ছোট ঘাড় বড় শরীরের লুট তৈরি করা হয়। তবে তা সাফল্য পায়নি। তার কিছু পরেই নির্মিত লুটগুলোর ঘাড় বা পেগবক্স অধিকতর লম্বা ছিল। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে বিচিত্র ধরনের লুটের আবির্ভাব ঘটে। এর মধ্যে আর্কলুট, ডাবল-হেডেড লুট থিওরবোস-এর নাম উল্লেখযোগ্য।

সতেরো শতকে ফ্রান্সে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে লুট ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সে সময় দেশটিতে তৈরি হওয়া লুটে তারের এগারোটি গুচ্ছ ছিল। আঠারো শতকের প্রথম দশকে লুটবাদক সুরকার সিলভিয়াস লিওপোল্ড ওয়েইস জার্মানিতে লুটকে দারুণ জনপ্রিয় করে তোলেন। সংগীত নিয়ে তার নিজস্ব কিছু বোঝাপড়া ছিল। তার ভিত্তিতে তিনি লুটে কিছু সংস্কার আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তার হাত ধরে তারের তেরোটি গুচ্ছবিশিষ্ট লুটের আবির্ভাব ঘটে। সে সময় এমন কিছু লুট তৈরি হয়, যেগুলোর ঘাড় ছিল হাঁসের গ্রীবার মতো।

আঠারো শতকের শেষার্ধে লুটের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। পুরনো অনেক লুটকে গিটারে রূপান্তরিত করা হয়। ধরনের হাইব্রিড লুট-গিটার বেশ কিছুদিন ফ্রান্সে প্রচলিত ছিল। তারপর সেগুলোর ব্যবহারও বন্ধ হয়ে যায়। দৃশ্যপট থেকে লুট একেবারে হারিয়ে যায়।

বিশ শতকের শেষের দিকে লুট তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করে। বর্তমানে এর বাদক নির্মাতারা লুটকে আবার তার মসনদে বসাতে কাজ করে যাচ্ছেন। সারা বিশ্বে লুট নির্মাণ একটি কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে।

 

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন: লেখক