আল্লাহু আল্লাহু
জিকির করে যাব আমি
মদনপুরে হজরত বাবা
শাহ সুলতান ঐ নামেতে
হব কুরবান।। আল্লাহু আল্লাহ
আল্লাহু আল্লাহ
ওরে ইসলামের
ঐ দাওয়াত
নিয়া আসলেন বাবা
মদনপুর কেউ চিনল
আর কেউ
চিনল না বাবা বড়
মন চোর।। আশেক ভক্তের
চোখের মণি বাবা তুমি
প্রেমের খনি শুয়ে শুয়ে
দিন রজনী খেলাও কত
প্রেমের খেলা আল্লাহু আল্লাহ
আল্লাহু আল্লাহ।। ওপরের সংগীত ইউটিউবের সুবাদে যেকোনো আগ্রহী শ্রোতা শুনতে পারবেন এবং সহজেই উপলব্ধি করবেন যে এটি ‘আল্লাহু আল্লাহু কিয়া কর তামাম দুনিয়া কা মালিক হো’ এই বিখ্যাত গানের সুরে গাওয়া হয়েছে। নেত্রকোনা জেলা সদরের মদনপুর গ্রামে অবস্থিত সুফি শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.)-এর ওরসের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই গানটির শিল্পী ঝুমা সরকার। গানটি আধুনিক বা সাম্প্রতিক কালের এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সাধক সুলতান কমর উদ্দিন রুমীর প্রাচীনত্ব ও কারামত সম্পর্কিত লোকগাথা অন্তত দুই শতাব্দী প্রাচীন। দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় সুফি কমর উদ্দিনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও সম্মান বর্তমান লোকসংগীতেও প্রকাশ পেয়েছে। গীতিকার নাদিম সরকারের লেখা লোকশিল্পী খুশি নূরীর কণ্ঠের নিম্নোক্ত গানে এই সাধককে সুদূর রোম শহরের বাসিন্দা হিসেবে বন্দনা করা হয়েছে; যিনি সেখানে থেকে ইসলামের প্রচার করতে মদনপুর গ্রামে এসেছেন। গানের ভাষায়— রুম শহরের
বাদশাহ তুমি বাবা
শাহ সুলতান মদনপুর আইসা
উড়াইলা ইসলামের নিশান।। বাংলা সিনেমার ভাটার কালেও চল্লিশোর্ধ যেকোনো সিনেমাপ্রেমী দর্শক অতি সহজেই বুঝবেন খুশি নূরীর গান এমএ খান সবুজ পরিচালিত ‘মধু পূর্ণিমা’ চলচিত্রের ‘প্রেমিক যে জন’ গানের সুরের অনুকরণে গাওয়া। ফোক বা লোকজ গানের ক্ষেত্রে এ রকম সাদৃশ্য বেমানান কিছু নয়। শাহ সুলতান কমর উদ্দিনের তথ্যসংবলিত লোকগাথায় থাকা কিংবদন্তি, কিংবা ওরসের গানের কালগত ফারাক থাকলেও ভাবগত নৈকট্য অত্যন্ত প্রবল। আশেকান, ভক্ত, মুরিদ ও মজলুমের জন্য তিনি মুক্তির মশাল, ইসলামের প্রচায়ক, মুর্শিদ কিংবা মাশুক। স্মৃতি ও শ্রুতির সাক্ষ্যে এই সাধকের অস্তিত্ব প্রায় সহস্রাব্দের। লিখিত প্রমাণবলে ১৬৭১ সালের মোগল দলিলে এই সুফির দরগা সংশ্লিষ্ট জমি ও মুতাওয়াল্লির কর্তৃত্বে ওয়াকফ করা হয়েছিল। কথ্য প্রমাণ ও দালিলিক সূত্রাদির বৈপরীত্য জনমানসে এ সুফির অস্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধার কমতি ঘটাতে পারেনি। যার প্রমাণ দেখা যায় প্রতি বছর ফাল্গুনের পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত বার্ষিক ওরসে। দলমত-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণীবিভক্তির বিভেদ ভুলে মানুষ দলে দলে তাদের নিবেদন জানায় সুফি কমর উদ্দিনের দরগায়। মেলায় বসে যায় ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, বাউল ও লোকগানের আসর। মাজারে মানত করে মানুষ দান করেন খাসি, গরু, গাভীর দুধ, কবুতর, মুরগি, হাঁস, নানা ধরনের তৈজসপত্র, আতপ চাল, তেল-মসলা। সঙ্গে রয়েছে নগদ অর্থ। ভাবাবেগ, প্রার্থনা, দুঃখ মুক্তি, স্রষ্টার সাধনায় প্রমাণ ও যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসের স্থান অনেক সুদৃঢ়। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণনির্ভর। কাল ও স্থান ইতিহাসের দুই জমিন। যা অতীত মানুষের কর্মকাণ্ডের পাটাতন। সুফি কমর উদ্দিনের মান্যতা স্বীকার করেই তার সম্পর্কিত প্রচলিত লোকগাথা ও দালিলিক সূত্রাদির পুনর্বিবেচনাই আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু। আশেক-ভক্ত-মুরিদ পাঠকের বিশ্বাস ভাঙার কোনো অভিপ্রায়ই আমার নেই। কেবল ইতিহাসের ‘তালবে এলেম’ হিসেবে বিদ্যমান গবেষণাকে সকলের সামনে তুলে ধরতে চাই। নেত্রকোনার কেন্দুয়ার সুফি কমর উদ্দিন রুমীর কাল নির্ণয় বিতর্কটির প্রথম কাঠামোগত ইতিহাস গবেষণায় তুলে আনেন মান্যবর গবেষক মুহাম্মদ এনামুল হক তার হিস্ট্রি অব সুফিজম ইন বেঙ্গল (A
History of Sufi-ism in Bengal ) গ্রন্থে। অধ্যাপক হক এই সুফির ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য ১৯১৭ সালে প্রকাশিত বেঙ্গল ডিসট্রিক্ট গ্যাজেটিয়ারস, ময়মনসিংহ (Bengal
District Gazetters, Mymensing) এ নথিভুক্ত লোকগাথা এবং ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের এ এস্টেট দখল প্রসঙ্গে উপস্থাপিত একটি ফার্সি দলিল বিশ্লেষণ করেন। লোকগাথার বক্তব্য ছিল এ রকম— The saint came to Mymensing and settled in the village of
Madanupur. The locality was then under the rule of a powerful Koch King. There
were no Muslims under the jurisdiction of the king except the saint and a few
of his companions... he attracted many people to him by the performance of
various miraculous deeds... whoever came in contact with the saint, accepted
Islam and became a devoted follower of the saint. (p 207) সুফির জনপ্রিয়তায় কোচ রাজা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি কমর উদ্দিনকে (র.) দরবারে নিয়ে আসেন এবং তার কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা জানতে চান। প্রতিউত্তরে সুফি নিজের ক্যারিশম্যাটিক ক্ষমতাকে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ঐশ্বরিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন। এনামুল হকের ভাষায় পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিম্নরূপ: In order to test the saint, The king ordered deadly poison to be
administered to him. He quaffed of a glass of the poison reciting the formula
of “Bismillah”... To the utter amazement of the king, the saint successfully
stood the test and all of those who were present voluntarily accepted Islam as
a matter of cause. The king became very much pleased to see the miracle and
ordered to dedicate the whole village of Modhupur to the saint. (p 210) এনামুল হকের উপস্থাপিত দ্বিতীয় সূত্রটির কালপর্ব দুই শতাব্দী আগের। ব্রিটিশ সরকার মাজার ও তত্সংলগ্ন লাখেরাজ জমি দখলের চেষ্টা করলে তত্কালীন মুতাওয়াল্লি পূর্বে উল্লিখিত ১০৮২ হিজরির ফারসি দলিল উপস্থাপন করেন। দলিলের বক্তব্যের ইংরেজি সারাংশ হলো: Shah Muhammad Sultan Rumi came with his preceptor Sayyid Shah Surkh
Khul Antiah to Modhupur and settled in it in the year 445 A.H.=1053 A.D. এ দলিলের ভিত্তিতেই জমির কর্তৃত্ব মুতাওয়াল্লির কাছে থেকে যায়। এনামুল হক এই ফারসি দলিলের প্রামাণিকতা মেনে নিয়ে প্রস্তাব করেন যে মদনপুর এলাকায় সুফি কমর উদ্দিন ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে এসেছিলেন এবং এই এলাকায় তার নেতৃত্বে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল। এনামুল হকের প্রস্তাবটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে সুফি আন্দোলন ও ইসলামের বিস্তারের ইতিহাসের অংশ। তিনি চারটি পর্বে ভারতের সুফি আন্দোলনকে ভাগ করেছিলেন। (ক)
Early
period: 1000-1150 A.D.; (খ) Period
of Establishment: 1152-1400 A.D. (গ) Period
of Fusion: 1350 A.D. downward (ঘ) Period
of Reformation: 1550 A.D. downward একাদশ শতকের শুরু থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত অসংখ্য সুফি বুখারা, সমরখন্দ, পারস্য, সিরিয়া এবং আরব ভূখণ্ড থেকে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের জন্য আগমন করেন। বখতিয়ার খলজির নদিয়া জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইসলাম বিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু হয় ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে। বাংলার ইতিহাসের পাঠক সমাজের কাছে এই তথ্য সুবিদিত। গবেষক মহলে বাহাসটি হয় ইতিহাসের তথ্যকে নির্ভর করে। এতত্সংশ্লিষ্ট সাওয়ালগুলো হলো—বখতিয়ার রাজ্য জয়ের আগে কি বাংলায় সুফিরা এসেছিলেন? ত্রয়োদশ শতকের আগে বাংলাদেশের কোথাও মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল কি? বাংলাদেশের কোন কোন এলাকা আদি পর্বে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্পর্শ পেয়েছিল? এই বাহাসটি প্রায় শতাব্দীকাল ধরেই গবেষক মহলে বিদ্যমান। তাছাড়া সাধক কমর উদ্দিনের কাল নির্ণয়ের সঙ্গে এ প্রশ্নগুলো আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ না-ও মনে হতে পারে। পরিসর বিবেচনায় পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে বিদ্যমান বিতর্কের সারাংশ পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই। ইতিহাসবিদ মুহাম্মাদ আব্দুর রহিম সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল হিস্ট্রি অব বেঙ্গল গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে বাংলা অঞ্চলে ইসলাম বিস্তার, মুসলিম বসতি স্থাপন, মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও স্থানীয় জনগণের ইসলাম ধর্ম গ্রহণসহ প্রাসঙ্গিক নানা বিষয় আকর সূত্র বিশ্লেষণপূর্বক পাঠক-গবেষক মহলে উপস্থাপন করেন। তার মতে, ১২০৪ সালের আগেই কতিপয় সুফি সাধক এ দেশের ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। কেননা তাবকাত-ই-নাসিরির গ্রন্থকার লিখেছেন, ‘মুহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজি বাংলাদেশে অনেকগুলো খানকা নির্মাণ করেন।’ আব্দুর রহিমের যুক্তি হলো: এই এলাকা জয়ের পূর্ব থেকে ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত সুফিদের জন্য ‘খানকাহ’ নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। খানকাহ নির্মাণের তথ্যের পাশাপাশি মিনহাজ সূত্রে এটিও জানা যায় যে নদিয়া নগরীর নিরাপত্তা বাহিনী বখতিয়ারের সৈন্যদলকে ঘোড়া ব্যবসায়ী হিসেবে ভুল করেছিল। এ কারণে বখতিয়ার বিনা বাধায় নগর প্রান্ত থেকে লক্ষণ সেনের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন। ফলে বোঝা যায় যে বখতিয়ারের আগেই বাংলাদেশের রাজদরবারে মুসলিম ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। এনামুল হক এ অরবীয় ও আরাকানি সূত্র বিশ্লেষণ করে দেখান যে অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত আরব ব্যবসায়ীরা বাহর-উল-হরকন্দ (বঙ্গোপসাগর) উপকূলে অবস্থিত সমন্দর (চট্টগ্রাম বা সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত) বন্দরে বাণিজ্য ও বসতি স্থাপন করেছিল। এ সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে মেঘনার মোহনা থেকে পূর্ব দিকে নাফ নদী পর্যন্ত আরবদের রাজনৈতিক আধিপত্য ছিল। আব্দুর রহিম প্রস্তাবটিকে নিম্নোক্ত চারটি যুক্তি দেখিয়ে পোক্ত করার চেষ্টা করেন: ক. প্রথম যুগের আরব ব্যবসায়ীরা বাংলার উপকূল সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলের প্রাচ্যদেশীয় আব্বাসীয় বাণিজ্য বলয় সুবিদিত। মালাবার, সিংহল, জাভা, সুমাত্রা, মালয়, বোর্নিয়াসহ এই জল-নেটওয়ার্কের অনেক দ্বীপেই মুসলিম ব্যবসায়ীরা বসতি স্থাপন করেছিল। সংগত কারণেই বাংলার ঐশ্বর্য এবং মূল্যবান পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এ আরব বণিকদের কিয়দংশ বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিল। খ. পঞ্চদশ শতকে বর্তমান বাংলাদেশের সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও এ-সংলগ্ন উপকূলে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। কিন্তু বারথেমা ও বারবোসা মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত ‘বাঙলা’ শহরে অসংখ্য ইরানি, আরব ও আবিসিনীয় ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য মুসলিম বসতি দেখেছিলেন। কীভাবে এ বসতি স্থাপিত হয়েছিল? এটি প্রমাণ করে বাংলার উপকূলীয় এলাকায় তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং সেই সূত্রেই তারা বসতি স্থাপন করেছিল। ৩. আরব বণিকদের আধিপত্যের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে কিছু স্থান নাম: চট্টগ্রাম (সমন্দর), গাঙ্গেয় বদ্বীপ (শাত-আল-গঙ্গা), বার্মিজ আরকানি শব্দ থুরা-তন (সুলতান)। এ শব্দগুচ্ছ এ অঞ্চলে একটি মুসলিম রাজ্যের স্মৃতিবাহক। ৪. ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় বহু আরবি শব্দ, বাগধারা ও ভাষা প্রয়োগ রীতির সংমিশ্রণ রয়েছে। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকের চট্টগ্রামের একাধিক কবির রচনায় আরবি শব্দমালার প্রয়োগ দেখা যায়। এটি প্রমাণ করে, বাংলাদেশে মুসলিম রাজ্য বিজয়ের আগেই চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আরব-মুসলিম বসতি ছিল। উপর্যুক্ত বৃহৎ প্রেক্ষাপটে স্থানীয় জনশ্রুতি বিশ্লেষণ করে মুহাম্মদ আব্দুর রহিম উপসংহার টানেন যে বাংলায় রাজনৈতিক বিজয়ের (১২০৪ সাল) পূর্বেই ইসলামের প্রচার ও মুসলিম বসতি স্থাপিত হয়েছিল। তিনি বখতিয়ার-পূর্ববর্তী সুফিদের তালিকায় (কিংবদন্তি ও লোক কাহিনীর অবলম্বনে প্রস্তুতকৃত) যাদের নাম শামিল করেছেন: বাবা আদম শহিদ (বিক্রমপুর, মুন্সিগঞ্জ), শাহ সুলতান রুমী (মদনপুর, কেন্দুয়া, নেত্রকোনা), শাহ সুলতান মাহিসোয়ার (মহাস্থান, বগুড়া), মখদুম শাহ দৌলা (পাবনা)। কিংবদন্তি অনুসারে, এই সুফিরা আরব বা ইরানের কোনো এলাকা থেকে সদলবলে বাংলাদেশে আসেন এবং স্থানীয় হিন্দু রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেন কিংবা অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করে স্থানীয় অমুসলিম রাজাকে ইসলামে অনুরক্ত করেন। কিংবদন্তিগুলোর কাঠামো বিন্যাস অনেকাংশেই সাযুজ্যপূর্ণ হলেও ইতিহাসের প্রামাণিক সূত্রাদির (লেখমালা, আরবি-ফারসি গ্রন্থ বা সমকালীন সূত্র) সাহায্যে ঘটনার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা নিরূপণ কষ্টকর। আবদুল করিম, Social History of the Muslims in Bengal (Down
to A.D. 1538)
উপযুক্ত প্রস্তাব বিপরীত বলয়ে নিজের অবস্থানকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বাংলাদেশের সুফি বাবা আদম শহিদ, শাহ সুলতান রুমি, শাহ সুলতান মাহিসোয়ার, মাখদুম শাহ দৌলাহ শহিদ—এই চারজন সাধক সম্পর্কিত স্থানীয় শ্রুতি বিশ্লেষণপূর্বক সিদ্ধান্ত নেন যে তারা সবাই মুসলিম বিজয়ের পরে; সম্ভবত মুসলিম শক্তি বিস্তারের প্রাথমিক বছরগুলোতে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় এসেছিলেন। পূর্ববর্তী গবেষকদের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা ত্রয়োদশ শতকের আগে মুসলিম বাণিজ্যবলয়-বসতি স্থাপন প্রস্তাব মেনে নিয়েই অধ্যাপক আব্দুল করিমের এই উপসংহার। ˆনত্রকোনার সুফি কমর উদ্দিনের কিংবদন্তি এবং লিখিত সূত্রাদির বিশ্লেষণে আবদুল করিম নতুন কোনো প্রামাণিক উৎস উপস্থাপন করেননি। তিনি Bengal District Gazetter Mymensing এর তথ্যাদির পুনরাবৃত্তি করে বলেন, কোচ রাজা ও সুফি রুমীর কাহিনী নিশ্চিতভাবেই অনেক পরের; কারণ, বাংলার ইতিহাসে ত্রয়োদশ শতকের সেন রাজাদের পতনের অনেক পরে ময়মনসিংহ নেত্রকোনা অঞ্চলে কোচদের রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম হয়। পূর্বসূরি গবেষকদের মতোই বর্তমান লেখকেরও শ্রুত-স্মৃতিভিত্তিক কিংবদন্তিই সুফি কমর উদ্দিনের ইতিহাসের একমাত্র অবলম্বন। কেননা এই সুফির দরগাসংশ্লিষ্ট এলাকা কিংবা পার্শ্ববর্তী নিকটতম এলাকায়ও মোগলপূর্ব যুগের কোনো আরবি-ফার্সি শিলালিপি বা মসজিদ পাওয়া যায়নি। নেত্রকোনা জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্যভান্ডার কিংবা হালনাগাদ তালিকা না থাকায় বর্তমান লেখকের ভরসা আলী আহাম্মদ খান আইয়োব রচিত নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস। সপ্তদশ শতকের নেত্রকোনার মদনপুরে শাহ সুলতান রুমী এবং তার সঙ্গীদের মাজার ছিল। এটি স্পষ্ট যে সুফি কমর উদ্দিন (র.) এই জেলায় প্রথম ইসলামের বীজ রোপণ করে গেছেন। পরবর্তী মুসলিম শাসকরা তাকে লালন ও প্রসার করেছেন (পৃ. ১৩০)। মিথ-কিংবদন্তি, লোকগাথা সাহিত্য ও ফোকলোরের শাস্ত্রীয় চর্চায় বহুল ব্যবহূত ও সর্বজনগ্রাহ্য আকর হলেও ইতিহাস ও প্রত্নচর্চায় ততটা দাপুটে অবস্থানে নেই। প্রাচ্যবিদ তালাল আসাদের ভাবনায় ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের চর্চায় মিথকে ব্যবহারের রোশনাই পাওয়া যাবে প্রত্নবিদ স্বাধীন সেনের ‘(মহা) স্থান-মাহাত্ম্য: স্থান, সংবেদ আর সময়ে বিবিধ আখ্যান’ প্রবন্ধে। লেখাটি বগুড়ার মহাস্থান এলাকার প্রত্নঐতিহ্য, হযরত শাহ সুলতান বলখি মাহিসোয়ার (র.); এতত্সংশ্লিষ্ট স্মৃতি-শ্রুত লোকগাথা এবং লেখকের নিজের বিজড়নের আখ্যান ও তত্ত্বকথা। তালাল আসাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেক্যুলার ও ধার্মিকতা এ দুটিকে পরস্পরবিরোধী প্রত্যয় ভাবাটা সমস্যাপূর্ণ। প্রথমটি দ্বিতীয়টির ধারাবাহিকতা নয়, এর থেকে কোনো সরল বিচ্ছেদও নয়...এমন কোনো সারসত্তা নেই যা পবিত্রতাকে বাদ দিয়ে দেয়...সেক্যুলার...বিশেষ কিছু আচরণ, জ্ঞান ও সংবেদনশীলতাকে একত্র করেছে। সেক্যুলার বিভিন্ন প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গেই ধার্মিকতার সঙ্গে লেপ্টে থাকে (পৃ. ১৯)। এ ভাবনার আলোকে তালাল আসাদসহ অন্য গবেষকরা প্রস্তাব করেছেন, ‘মিথ যদি কিছু মানদণ্ড মোতাবেক গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আওতাভুক্ত হয় তাহলে মিথ ইতিহাসে ও প্রত্নতত্ত্বে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়।’ (পৃ. ৮) আমাদের প্রস্তাবে মিথকে অতিমানবীয় জগৎ, পবিত্র সময়, পবিত্র সত্তা ও স্থানসংশ্লিষ্ট ভাবনা হিসেবে দেখা হয়। ইউরোপের জ্ঞানজগতের ইতিহাসে Age of
Enlightment-পরবর্তী সময়ে নানা ঘটনার ও ভাবনার টানাপড়েন-মিথস্ক্রিয়ায় মিথকে অযৌক্তিক, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের তকমা দেয়া হয়। সাধক দরবেশ কমর উদ্দিন রুমীর আলোচনায় এ তাত্ত্বিক কাঠামো উপস্থাপন অথবা বাংলা অঞ্চলে ইসলাম বিস্তারের বৃহৎ পরিসর আলোচনা ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ মনে হতে পারে। তাই সংযত কলমে ফিরতে চাই কমর উদ্দিন (র.) সম্পর্কিত কয়েকটি জনশ্রুত-স্মৃতি উপস্থাপনে। জনশ্রুতিগুলোর প্রামাণিকতা পাঠকের কাছেই ন্যস্ত রইল। নূরুল হোসেন খন্দকার, শাহ সুলতান রুমী (র.) গ্রন্থের ‘অলৌকিক ঘটনা’ অধ্যায়ে এই সুফি সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি ‘কারামত’ নথিভুক্ত করেছেন। এই লেখকের ভাবনায় ‘সাধারণ আত্মাও শক্তি, বিশেষ আত্মাও শক্তি...দেহ প্রাচীর গেলে, আত্মার খণ্ড বিচ্ছিন্ন জীব-প্রক্রিয়া-জগতের কাজ অবসান হয়ে যায়। দেহমুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই আত্মার গতিশক্তি ও পবিত্রতা অসম্ভব ব্যাপকতা লাভ করলেও সে যে আদবের একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগৎ (পৃ. ২১১)। যদি কোনো শক্তিশালী আত্মা শুধু এইটুকু মনে রাখতে পারেন, ওখানে আমার জন্মভূমি ছিল এবং ওরা ছিলেন আমার অতি প্রিয়জন, তিনি আউলিয়া না হোন, তিনি কামেল এবং তার সমাধিস্থলই সজীব গোরস্থান! তাই যদি হয় আউলিয়াকুল শিরোমণি মহর্ষি হযরত শাহ সুলতান (র.) অদৃশ্য ও অশরীরী হলেও তিনি যে সম্পূর্ণ জীবিত, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই (পৃ. ২১১) ।’ লেখক কর্তৃক নথিভুক্ত ঘটনাগুলো নিম্নরূপ: ক. ১৯১২-১৭ সালের ভূমি জরিপের সময় এই সাধকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শেকল ফেললে তা ছিঁড়ে যেত। এ ঘটনা কুসংস্কার ও মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য জনৈক শিক্ষিত কানুনগো স্বহস্তে শিকল মাপতে শুরু করেন। হঠাৎ তিনি ভয়ংকর একটি ত্রিভুজের মধ্যে প্রবেশ করেন। তার স্মৃতি লোপ পায় এবং তিনি জমি মাপা বাদ দিয়ে নিজের মাথার হ্যাট নিয়ে খেলা শুরু করেন। পরবর্তীতে জনৈক ধার্মিক কানুনগো দোয়া-দরুদের আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা করে সুফির রুহানি অনুমতি নিতে সক্ষম হন। তবুও দরগা এলাকায় কেউ জায়গা মাপতে সাহস পাননি। খানকাহর সীমানা ১২ একর নির্ধারণ করে তারপর বাকি জমি জরিপ করতে পারেন। খ. ১৯৫৬ সালে চলতে অক্ষম জনৈক বৃদ্ধা একজন লোভী যুবকের হাতে একটি পাকা কাঁঠাল মাজার শরিফে শিরনি হিসেবে পাঠান। রাস্তায় এই যুবক অর্ধেক কাঁঠাল খেয়ে ফেলে। বাকি অর্ধেকটা মাজারের খাদেম শিরনি হিসেবে নেন না। যুবকটি বাকিটাও খেয়ে নেয়। ওই যুবক মাজারসংলগ্ন অতিথিশালায় রাতে ছিল। কিন্তু সকাল বেলায় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। খুঁজতে খুঁজতে দেখা যায় যুবকটি কাছে একটি বেতকাঁটার জঙ্গলের মধ্যবর্তী একটি ঝাউ গাছের আগায় বসে আছে এবং তার জবান বন্ধ। কোনো মানুষের পক্ষেই ওই গাছে চড়া সম্ভব না। কেননা বিশ-পঁচিশ হাত ঝাউগাছের কোনো ডাল থাকে না। কাজেই সুপারি গাছের মতো লম্বা, ডালপালাহীন এবং তার চেয়ে মোটা ঝাউবৃক্ষে ওঠার কোনো উপায় নেই। অনেক কলাকৌশলে তাকে নামিয়ে দেখা যায় তার পিঠে চাবুকের দাগ এবং চক্ষু রক্তবর্ণ। সর্বসম্মতিক্রমে বেয়াদবি মাফের জন্য দোয়ার আয়োজনে তার জবান খুলে যায়। যুবকটি বলে নিদ্রারত অবস্থায় পাঁচজন যুবক তাকে চাবুক মারতে মারতে জবান বন্ধ করে ফেলে। চারজন তাকে মেরে ফেলতে চাইলেও পঞ্চম ব্যক্তির অনুরোধে তা করা হয়নি। ভয়ে দৌড়ে তিনি ঝাউগাছে ওঠেন। সবার আশ্বস্ত বাণীতে যুবকের ভয় কাটে এবং তিনি সাতদিন দরগায় অবস্থান করে সুস্থ হয়ে চলে যান। গ. বিগত দশকের কোনো এক সময় একজন মাদ্রাসার ছাত্র দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। ধনী বাবার এই সন্তানের সব চিকিৎসার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পিতা নিরুপায় হয়ে হযরত শাহ সুলতানের দরগায় ছেলের সুস্থতার জন্য একটি ষাঁড় মাজার শরিফে দান করবেন বলে নিয়ত করেন। এরপর ছেলে সুস্থ হয়ে যায়। মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ছেলেটির বাবাকে বলেন যে ষাঁড়ের টাকা মাজার শরিফে না দিয়ে মাদ্রাসার দরিদ্র তহবিলে দিলে বেশি সওয়াব হবে। ব্যবসায়ীটি তা-ই করে। কিন্তু ছেলেটি পাগল হয়ে যায়। নিরুপায় বাবা দরগার খাদেমের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী আর একটি ষাঁড় কিনে মাজার শরিফে দান করার পর ছেলে পাগলামি থেকে সুস্থতা লাভ করে। প্রাচ্যবিদ তালাল আসাদের ভাবনায় নুরুল হোসেন খন্দকার বর্ণিত উপর্যুক্ত ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। বিজ্ঞান, যুক্তি, প্রমাণসিদ্ধ না হলেও খন্দকারের লেখনিতে বিশ্বাস-স্মৃতি-শ্রুত আর শরিয়ত-মারেফাতের প্রাধান্য সুস্পষ্ট। ইতিহাস লেখনীতে কাঁচা শহিদুল হাসান তো নস্যি। বাংলাদেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সুফি দরবেশ সাধকের মাজার-খানকাহ-দরগাকেন্দ্রিক এ রকম অলৌকিক স্মৃতি-শ্রুতি-লোকগাথা রয়েছে। ‘বিশ্বাসে মেলায় ভক্তি, তর্কে বহুদূর’—এই ভাবনায় এগুলোকে দেখার কোনো সুযোগ হয়তো বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস রচনার কায়দা-কানুনে নেই। নেত্রকোনার শাহ কমর উদ্দিন রুমী (র.) কে সহস্রাধিক আগের সাধক—কাল বিবেচনার এ বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নতা ও সংশয় থাকলেও এতদঞ্চলে ইসলাম প্রচারে এই মহান সাধকের অবদান অনস্বীকার্য। ভক্তের হূদয়ে তিনি মুশকিল আশান। মুরিদের কলবে বাবা-পীর। আশেকান-মুরিদান-ভক্তকুলের শাহ কমর উদ্দিন রুমির দরগায় যাওয়ার ব্যাকুলতার সঙ্গে সম্পর্ক নেই যুক্তি, প্রমাণ, বিজ্ঞান কিংবা কেতাবি জ্ঞান জগতের। সমাপ্তি টানতে চাই খাদিজা ভাণ্ডারীর সাথে সুর মিলিয়ে— আয় কে
যাবি মদনপুরে আয়রে তোরা
আয় কী খেলা
জমায়েছে আমার সুলতান
শাহ বাবায়। জ্বালাইয়া মোমের
বাতি এক ধ্যানে
চায় দুই হাত
উঠাইয়া ভক্ত
ক্ষমা ভিক্ষা
চায় পাগল ফকির
মজনু মস্তান দরবারেতে যায় আশেক আর
মাশুক তারা প্রেম খেলা
খেলায় সুলেমানের মনের
আশা পাইতে তোমায় ঘূর্ণী দানে
দিয়ো দেখা বলে খাদিজায় ঘূর্ণী দানে
দিয়ো দেখা কঠিন পুলসিরায়।। শহিদুল হাসান: সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়