সিল্করুট

খাদেমদের দুই বংশ

ফরাস ও ফকির

অমিত রহমান

মাজার শরিফে মানত শিরনি আদায়ের স্থান ছবি: ভজন দাস

রুম অঞ্চল থেকে এসেছিলেন তিনি, তাই নামের শেষে রয়েছে রুমী। শাহ সুলতান রুমী (.) কে নিয়ে আসলে ঐতিহাসিক দলিলের তুলনায় লোকমুখে প্রচলিত কথাই বেশি পাওয়া যায়। তার সম্পর্কে দুই রকম মতবাদ আছে। প্রথমত, বলা হয় তাকে রুমের বাদশাহ সিংহাসনে বসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সিংহাসন ত্যাগ করে ইসলামের খেদমতে বের হন। ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি উপমহাদেশে এসেছিলেন। ১২০ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি জলপথে চট্টগ্রামে (তত্কালীন চট্টলা বন্দর) এসেছিলেন। সেখান থেকে নানা অঞ্চল ঘুরে ৪০ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি মদনপুরে আসেন। সেখানে তখন পাল শাসন চলছিল আর মদনপুর ছিল মদনমোহন কোচ নামে এক কোচ রাজার অধীনে।

মদনপুরে প্রচলিত আছে কমর উদ্দিন রুমী (.) এখানে একটি জায়গায় জায়নামাজ বিছিয়ে সংগীতের নিয়ে নামাজ পড়েছিলেন। জায়গাটি নামাজখানা নামে পরিচিত। অঞ্চল থেকে কমর উদ্দিন রুমী মদনমোহনকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। কোচ রাজা তা মানেননি। নিজ লোক দিয়ে রুমীকে উত্খাত করার চেষ্টা করেন কিন্তু তারাও রুমীর কিছু কারামত (অলৌকিক ঘটনা) দেখে তার ভক্ত বনে যায়। কিন্তু মদনমোহন থেমে যাননি। তিনি রুমীকে হেনস্তা করার চেষ্টা করেন।

মদনমোহন রুমীকে তার দরবারে দাওয়াত করেন এবং কথিত আছে তার পানীয়তে ১৪ তোলা বিষ মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল। কমর উদ্দিন (.) তা টের পেয়ে সঙ্গীদের ওই পানীয় গ্রহণ করতে নিষেধ করেন। তিনি নিজে ওই পানি পান করে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। অলৌকিক বিষয় দেখে রাজা হতভম্ব হয়ে যান। এরপর রাজা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এমন কথা প্রচলিত আছে। আবার বলা হয় তিনি কমর উদ্দিন (.) কে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু রুমী (.) সে কথা মানেননি। আরেকটি কথা প্রচলিত আছে যে রাজাই সে স্থান ত্যাগ করে চলে যান। ওই অঞ্চল পুরোটাই ছিল মদনমোহন তার পরিবারের অধীনে। সেখানেই শাহ রুমী (.) নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

নেত্রকোনা অঞ্চলে প্রচলিত কথায় কমর উদ্দিন রুমী (.)-এর সময় থেকে বলা যায় বাংলায় তিনিই সবার আগে ইসলাম প্রচার করেছেন। সিলেটের শাহ জালালের (.) অন্তত ২০০-২৫০ বছর আগে তিনি এখানে এসে ধর্মপ্রচার করেন। তবে কমর উদ্দিন রুমী (.) কে নিয়ে অঞ্চলে তেমন কোনো কাজ হয়নি। ইতিহাস বা অন্যান্য কোনো ক্ষেত্রে তাকে নিয়ে গবেষণার অভাব আছে। তবে স্মৃতি বা প্রমাণ হিসেবে আছে তার মাজারটি। এটি শুরুতে মাজারের খাদেমরাই দেখাশোনা পরিচালনা করতেন। এরপর একসময় জেলা প্রশাসক পদাধিকারবলে মাজার কমিটির সভাপতি হন। এছাড়া প্রতি বছর কমিটি থেকে খাদেমদের নির্বাচন করা হয়।

মাজার কেন্দ্রিক খাদেমদের দুটি ভাগ আছে। বলা হয় কমর উদ্দিন রুমী (.)-এর ১০-১২ জন সঙ্গী ছিলেন এবং তাদের বংশধররাই কালক্রমে খাদেম হয়েছেন তার মাজারের। তারা এই গ্রামেই বসবাস করেন। তবে তাদের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। খাদেমদের দুই ভাগ আছেফরাস ফকির। যারা আস্তানায় সবসময় থাকতেন তাদের বলা হতো ফরাস এবং বাইরে যারা দাওয়াতি কাজ করতেন তারা ফকির। এখনো ধারা বজায় রেখেই কাজ করেন খাদেমরা। বাইরের কেউ জিয়ারত করতে এলে জিয়ারতের নিয়মকানুন ফকিররা দেখভাল করে। মাজারের ভেতরে গেলে জিয়ারতের নিয়মকানুন দেখিয়ে দেয়ার কাজগুলো করে ফরাস বংশের ওরা। এখানে যারা আছে সবারই চাকরি বাকরি এসব আছে। তার পাশাপাশি এসব করে। কাজের জন্য নির্ধারিত চার্ট করা আছে, যে আজ ফরাস বংশের কতজন কোন কোন দায়িত্ব পালন করবেন আর আজ ফকির বংশের কতজন।

এখনো মাজারে নিয়মিত ডঙ্কা বাজানো হয়। ডঙ্কা বলতে ঢোলের মতো একটা বাদ্য। মাগরিবের নামাজের সময়ে ভেতরে যখন বাতি দেয়া হয় তখন ডঙ্কা বাজানো হয়। এর মানে ভেতরে বাতি দেয়ার সময় হয়েছে। তখন যারা দায়িত্বে থাকে তারা গিয়ে মাজারে বাতি জ্বালাবে।

এছাড়া আরো কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা হয়। কেউ কেউ আসে পিরের বাড়িতে একদিন থাকবে, খেদমত করবে পিরের, সেজন্য। সেসবের ব্যবস্থা করা হয়। হয়তো ৩০ টাকা দিয়ে নামটা উঠাল যে আমরা খেদমত করব। পরে খাওয়া দাওয়াও হয় মাজারের পক্ষ থেকে।

এখানে যেসব স্মৃতিচিহ্নের কথা বলা যায়, সেগুলো হলো যেখানে প্রথম নামাজ পড়েছিলেন সেটা নামাজখানা নামে পরিচিত, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। যে মসজিদটা করেছিলেন, সেই মসজিদ তো আর নেই। ওই ঘরটা আর নেই। ধীরে ধীরে সংস্কারের পরে সেটা বড় মসজিদ হয়েছে। শাহ সুলতান জামে মসজিদ, সেটা মাজারের পাশেই। তাছাড়া একটা মক্তব ছিল। এতিমখানা হিসেবে মাজারের পাশেই সেটা এখন চলে। এছাড়া তার নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান আছে। শাহ সুলতান ডিগ্রি কলেজ, শাহ সুলতান উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা এসব তো আছেই। এছাড়া এমন আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কমর উদ্দিন রুমী (.)-এর মাজারের পাশে যেসব কবর রয়েছে, সেগুলো তার সঙ্গে যারা এসেছিলেন সেই সব সাথীদের।

ওলি-আল্লাহর মাজার হিসেবে দূরের মানুষ তো আসেনই এখানে, স্থানীয়দের ওপর বেশ প্রভাব আছে মাজারটির। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে শাহ সুলতানের ওরশ হয়। ৪০-৫০ বছর বা আরো আগে থেকেই ওরস শুরু হয়েছে। ফাল্গুন মাসের চাঁদের পূর্ণিমার আশপাশে তিনদিন হয় ওরস। তখন লাখ লাখ মানুষের আসা-যাওয়া হয়। প্রতিদিনই কমবেশি ভক্ত আসে ওরসে শরিক হতে। বৃহস্পতি রোববার বেশি মানুষের আগমন হয়। এই দুদিন হাটবার বলে প্রচলিত, তাই সেদিন জমায়েত বেশি হয়। মাজারকে ঘিরে তখন উৎসবের আবহ তৈরি হয়। এর মধ্যেই ভক্তরা স্মরণ করেন কমর উদ্দিন রুমী (.) কে।

 

অমিত রহমান: লেখক