বাংলাদেশী ব্র্যান্ড ওয়ালটন এখন বিশ্বজুড়ে

ছবি : বণিক বার্তা

টাঙ্গাইলের প্রথিতযশা শিল্পোদ্যোক্তা আলহাজ এসএম নজরুল ইসলামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৭ সালে শুরু হয় ওয়ালটনের পথচলা। পরবর্তী সময়ে তার সুযোগ্য পাঁচ ছেলে এসএম নুরুল আলম রেজভী, এসএম শামছুল আলম, এসএম আশরাফুল আলম, এসএম মাহবুবুল আলম ও এসএম রেজাউল আলমের বিচক্ষণ নেতৃত্বে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাংলাদেশী এ ব্র্যান্ড এখন পৌঁছে গেছে বিশ্বজুড়ে। 

বড় ভাই এসএম নুরুল আলম রেজভীর নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালে পাঁচ ভাই মিলিতভাবে সাদা-কালো টেলিভিশন সেট আমদানির ব্যবসা শুরু করেন। তখন তারা ভাবেননি যে একদিন এ প্রতিষ্ঠান এত বিশাল হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে উচ্চারিত হবে ওয়ালটনের নাম। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হাজারো মানুষের মনে জায়গা করে মাত্র তিন দশকের মধ্যেই ওয়ালটন নিয়ে আসে বিভিন্ন সেবা। টেলিভিশন বিক্রিতে সফলতা লাভের পর প্রতিষ্ঠানটি আরো বড় ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হয়। বর্তমানে ওয়ালটন প্রায় সাড়ে চার হাজার প্রকার বৈদ্যুতিক এবং বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদন ও অ্যাসেম্বলের মাধ্যমে বিপণন ও বিতরণ করে। এর মধ্যে ওয়ালটনের হোম অ্যাপ্লায়েন্স অন্যতম। তবে শুরুতে বাংলাদেশী ব্র্যান্ড হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে কিছুটা সময় লেগেছে তাদের। কিন্তু কোয়ালিটি পণ্য দিয়ে স্থানীয় বাজারে গ্রাহকপ্রিয়তার শীর্ষে যেতে ঠিকই সক্ষম হয়েছে। দেশের মানুষের আস্থা অর্জন এবং সেই আত্মবিশ্বাসে ওয়ালটন ২০১০ সালে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করে।

ওয়ালটনের উদ্যোক্তা প্রয়াত এসএম নজরুল ইসলামের স্বপ্ন ছিল দেশেই আন্তর্জাতিক মানের ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল পণ্য উৎপাদন করা। সে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ২০০৫ সালের শেষ দিকে রাজধানী থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রায় জমি কিনে শুরু করেন কারখানা নির্মাণের কাজ। কোম্পানিটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৮ সালে, ফ্রিজ তৈরির মাধ্যমে। এরপর ২০১০ সালে এয়ারকন্ডিশনার তৈরির পূর্ণাঙ্গ কারখানা চালুর পাশাপাশি শুরু হয় টেলিভিশন ও হোম অ্যাপ্লায়ান্স পণ্যের বাণিজ্যিক উৎপাদন। ২০১৭ সালে ওয়ালটন চালু করে দেশের প্রথম ও একমাত্র কম্প্রেসর উৎপাদন কারখানা। ২০১৭ সালে দেশের প্রথম মোবাইল ফোন উৎপাদন কারখানা চালু করে ওয়ালটন। ২০১৮ সালে কোম্পানিটি দেশেই কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও আইসিটি পণ্য উৎপাদন শুরু করে। 

এরপর পর্যায়ক্রমে লিফট বা এলিভেটর থেকে শুরু করে ৫০ হাজারটিরও বেশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যাটেরিয়ালস বা শিল্পপণ্য উৎপাদনে যায় ওয়ালটন। ভবিষ্যতে ইলেকট্রিক ভেহিক্যালস তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ওয়ালটনের, যা নিয়ে কয়েক বছর ধরে ব্যাপক গবেষণা চালাচ্ছেন তাদের আরঅ্যান্ডআই টিমের প্রকৌশলীরা। বর্তমানে ওয়ালটন হাই-টেক পার্কে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও ফিচারসমৃদ্ধ আন্তর্জাতিক মানের রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, কম্প্রেসর, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ব্লেন্ডার, রাইসকুকার, গ্যাস স্টোভ, ইন্ডাকশন কুকার, এলইডি লাইট, বাল্ব, বিভিন্ন ধরনের ফ্যান, সুইস-সকেট, লিফট বা এলিভেটর, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, প্রিন্টার, মনিটর, ইলেকট্রিক বাইক, নাট, বোল্ট, স্ক্রু, মাস্টারব্যাচ ইত্যাদি ১০০টিরও বেশি ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিকস, হোম ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স, আইটি ভিভাইস, অ্যাকসেসরিজসহ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সলিউশনস পণ্য। সেই সঙ্গে ৩০ হাজারেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে ওয়ালটনে।

দেড় দশক আগেও দেশের ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজার পুরোপুরি আমদানিনির্ভর ছিল। ওই সময় বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি বাবদ একদিকে ব্যয় হতো বিশাল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা; অন্যদিকে ফ্রিজ, টিভির মতো ইলেকট্রনিক পণ্যের দামও ছিল আকাশছোঁয়া। তাই তখন ইলেকট্রনিকস ছিল বিলাসপণ্য। কিন্তু ওয়ালটন স্থানীয় পর্যায়ে ফ্রিজ, টিভি, এসিসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদন শুরুর পর দেশীয় এ খাতের আমদানিনির্ভরতা কমে আসে উল্লেখযোগ্য হারে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোকে প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলে স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণে শীর্ষে উঠে আসে ওয়ালটন। বর্তমানে দেশের সিংহভাগ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ওয়ালটনের তৈরি পণ্য রফতানি হচ্ছে ভারত, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইরাক, ইয়েমেন, নাইজেরিয়া, ঘানা, পূর্ব তিমুর, তুরস্ক, জার্মানি, পোল্যান্ড, গ্রিস, ইতালি, রোমানিয়া, আয়ারল্যান্ডসহ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপ অঞ্চলের ৪০টিরও বেশি দেশে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত ওয়ালটনের তৈরি আন্তর্জাতিক মানের পণ্য দিয়ে বিশ্বক্রেতাদের আস্থা জয় করে বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে। বাড়ছে দেশের রফতানি আয়, রিজার্ভে যোগ হচ্ছে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। 

বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে ওয়ালটনের রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, ফ্যান ইত্যাদি পণ্যের। ইউরোপের বাজারে বেশি রফতানি হচ্ছে টেলিভিশন। ভারতে রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, ফ্যান ইত্যাদি পণ্যের চাহিদা বেশি। এর পাশাপাশি রাইসকুকার, ব্লেন্ডার ইত্যাদি কিচেন অ্যাপ্লায়েন্সও রফতানি হচ্ছে।

ওয়ালটনের লক্ষ্য বিশ্বের অন্যতম সেরা ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ড হয়ে ওঠা। ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের সেরা পাঁচ ব্র্যান্ডের একটা হওয়া। তাই ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত বিশ্বে রফতানির বাজার সম্প্রসারণে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। লক্ষ্য পূরণে পণ্য উৎপাদন পর্যায়ে অনুসরণ করছে ‘ফিট ফর অল’ নীতি। অর্থাৎ ওয়ালটন নিজস্ব কারখানায় বিশ্বের যেকোনো দেশের আবহাওয়া উপযোগী এবং ভিন্ন ভিন্ন দেশের ক্রেতাদের রুচি, অভ্যাস, পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী উচ্চ গুণগতমানের ইলেকট্রনিকস, ইলেকট্রিক্যাল ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সেস উৎপাদন করছে। গঠন করা হয়েছে সুদক্ষ ও চৌকস গ্লোবাল বিজনেস টিম। পাশাপাশি কয়েকটি দেশে সাবসিডিয়ারি ও শাখা অফিস স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ায় ওয়ালটন স্থাপন করেছে রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার। সেখানে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও ফিচারের উদ্ভাবনী পণ্যের পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকার স্ট্যান্ডার্ড, আবহাওয়া এবং ক্রেতাদের চাহিদা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চালানো হচ্ছে। ফলে ওয়ালটনের তৈরি পণ্য বৈশ্বিক ক্রেতাদের আস্থা জয় করে নতুন নতুন দেশে রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে অতিদ্রুত।

ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ ২০২০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে সাড়ে ৯৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কোম্পানিটির উদ্যোক্তাদের হাতে। বাকি দেড় শতাংশ শেয়ার বিদেশী, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণীর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে। 

ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ওয়ালটন মাইক্রো-টেক ইন্ডাস্টিজ লিমিটেড, ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ওয়ালটন করপোরেশন, ওয়ালটন প্লাজা, ওয়ালটন ই-প্লাজা ইত‌্যাদি হচ্ছে এ গ্রুপের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান। ওয়ালটনে যারা কাজ করেন তাদের কখনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী বলা হয় না। সবাই তারা ওয়ালটন পরিবার। ওয়ালটন তার পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ফ্যাক্টরিতে কর্মীদের যে খাবার দেয়া হয়, সেটা নিজেদের তৈরি। বাইরের খাবারে ভেজাল থাকতে পারে। পুষ্টিগুণ পুরোপুরি না থাকতে পারে, এসব চিন্তা থেকে নিজেরাই নিজেদের খাবার তৈরি করে থাকে।

কর্মীদের শরীরচর্চার জন্য রয়েছে বিশাল একটি ব্যায়ামাগার। আছে ইনডোর খেলার মাঠ। অনেক মায়েদের সন্তান দেখার মতো ঘরে কেউ নেই। তারা সন্তানকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। কেননা ওয়ালটনে রয়েছে ডে-কেয়ার সেন্টার, যেখানে শিশুরা থাকে সযত্নে। এছাড়া মেডিকেল সেবা তো আছেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন