সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি হয়েছিল ইগলু আইসক্রিম ফ্যাক্টরি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

আব্দুল মোনেম। বাংলাদেশের নির্মাণ শিল্পের পথিকৃৎ। যিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন সফল ব্যবসায়ী। আব্দুল মোনেম লিমিটেডের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইগলু আইসক্রিম। পরে ১৯৫৬ সালে মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড (এএমএল) গড়ে তোলেন। নিজের নামে গড়া সে প্রতিষ্ঠান একসময় হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম শীর্ষ কনস্ট্রাকশন ফার্ম।

পরবর্তী সময়ে খাদ্য, পানীয়, চিনি পরিশোধনাগার, জ্বালানি, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। এএমএলের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইগলু আইসক্রিম লিমিটেড। স্বাধীনতার আগে ইগলু আইসক্রিমের মালিক ছিলেন পাকিস্তানের কে রহমান এবং কোম্পানি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর এনিমি সম্পত্তি হিসেবে তখনকার সরকার থেকে কারখানাটি ১৯৮৩-৮৪ সালে প্রয়াত আব্দুল মোনেম কিনে নেন। তখন এ কারখানার অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে। এরপর আব্দুল মোনেম ১৯৯০ সালে আইসক্রিম কারখানাটি বর্তমান ঠিকানা: ১৮, রাজউক দ্বিতীয় পর্ব ঠিকানায় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। কারখানা নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১৪৫ কোটি ২৮ লাখ ২৮ হাজার টাকা।

কারখানা নির্মাণের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রাথমিক খরচ (ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট), যা আব্দুল মোনেম সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে করেছিলেন। ১৯৯০ সালে বর্তমান ঠিকানার জমি ও আশপাশের জায়গা পানির নিচে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ছিল। এ ধরনের জায়গা ভরাট করা সম্ভব হয়েছিল শুধু তার একনিষ্ঠ কর্মদক্ষতার কারণে। উনি মাঝে মাঝেই মাটি ভরাটের কাজ দেখতে সরেজমিনে উপস্থিত হতেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের/অধিদপ্তরে আবেদন করে অনেক প্রতিকূলতা পার করে বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পরিবেশের অনুমোদন নেয়া হয়েছিল। ওই সময় কারখানার যন্ত্রপাতিগুলো আনা হয়েছিল ইতালি থেকে। সে সময় যন্ত্রপাতিগুলো এলসি করে আনাও ছিল অনেক জটিল ব্যাপার। যেহেতু আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিতে এ প্রতিষ্ঠানই প্রথম, সেহেতু স্কিল শ্রমিক পাওয়াও সম্ভব ছিল না। তাই বিদেশ থেকে ট্রেইনার এনে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্কিলড করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাকালে কারখানাটির দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৫০০ লিটার। শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৩০-৪০। বর্তমানে শ্রমিক সংখ্যা ২৫০ এবং ৩০১ জনের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ শ্রমিক আইন ২০০৬ অনুযায়ী কারখানার শ্রমিকদের সব সুবিধা দেয়া হয়। তবে কারখানাটিতে বর্তমানে কোনো বিদেশী প্রকৌশলী কাজ করছেন না। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে উৎপাদিত কোনো পণ্য বিদেশেও রফতানি হয় না। তবে প্রতিষ্ঠানটি প্রযুক্তিগত দিক থেকেও অনেক উন্নত। প্রতিষ্ঠানটিতে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তার বেশির ভাগই আমদানি করা। যেমন চীন, ডেনমার্ক, ইতালি, যুক্তরাজ্য থেকে আনা। কারখানাটির যেসব যন্ত্রপাতি আছে স্টিক লাইন, ফিলিং লাইন, সেমি অটো ফিলার, মিক্স প্লান্ট, স্পাইরাল ফ্রিজার, ফ্রুট ফিডার, কোন মেশিন ও চকোলেট প্লান্টসহ অনেক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। উৎপাদনের ভিত্তিতে প্রায় ১০ গুণ সম্প্রসারণ হয়েছে। সম্প্রতি এমডি এএসএম মঈনউদ্দিন মোনেম কারখানাটি আরো সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নিয়েছেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বাজারের আকার ৩৭২৯১১২৬১০.৯৫ টাকা ও বাজার অংশীদারত্ব ৩৪ শতাংশ দখল করে আছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে—স্টিক আইসক্রিম, ললি আইসক্রিম, কাপ আইসক্রিম, কোন আইসক্রিম, ফ্রোজেন ডেজার্ট, লিটার আইটেমস। বার্ষিক উৎপাদনসক্ষমতা স্টিক আইসক্রিম ৩৩২৮৯৩৪ লিটার, ললি আইসক্রিম ৪২০৪১৩ লিটার, কাপ আইসক্রিম ৪৩২৭১৬৪ লিটার, কোন আইসক্রিম ৩১৭৪৮২৫ লিটার, ফ্রোজেন ডেজার্ট ১৩০৪৮০ লিটার, লিটার আইটেমস ৭২৬৮৮৪১ লিটার। মোট ১৮৬৫০৬৫৭ লিটার/বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা প্রতিষ্ঠানটির। এছাড়া বার্ষিক টার্নওভার বা রেভিনিউর ক্ষেত্রে স্টিক আইসক্রিম ৫৬৫.৬৯২ মিলিয়ন, ললি আইসক্রিম ৪৮.৭৮৬ মিলিয়ন, কাপ আইসক্রিম ৪৪৬.৮৮৫ মিলিয়ন, কোন আইসক্রিম ৫১৭.৭৮৮ মিলিয়ন, ফ্রোজেন ডেজার্ট ৩৫.৭২৪ মিলিয়ন, লিটার আইটেমস ৮৩৮.৭৩৭ মিলিয়ন টাকা আয় করে। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক রেভিনিউ মোট ২৪৫৩.৬১২ মিলিয়ন টাকা।

১৯৩৭ সালের ৫ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি অনগ্রসর গ্রাম বিজেশ্বরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আব্দুল মোনেমের জন্ম। মাত্র তিন মাস বয়সে বাবাকে হারান আব্দুল মোনেম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিভৃত সেই গ্রামে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বড় হয়েছেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ২০২০ সালের ৩১ মে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন