ফেনীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও ফেরেনি পাঠদানের পরিবেশ

নুর উল্লাহ কায়সার, ফেনী

ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আসবাব, কাগজপত্র ও ল্যাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেগুলো শুকিয়ে সচল করার চেষ্টা করা হচ্ছে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যা ফেনীর সবকিছুই লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। বিশেষ করে জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, কম্পিউটার, নথিপত্র, আসবাব ও নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বাড়িঘরে পানি উঠে নষ্ট হয়েছে বই-খাতা। গত রোববার থেকে খুলতে শুরু করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এখনো শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টার। কিছু শিক্ষার্থী পাঠশালায় এলেও বই না থাকায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যায় শিক্ষার্থীদের বাড়িঘরে পানি উঠে আসবাবপত্রের সঙ্গে বই ও শিক্ষা উপকরণ নষ্ট হয়ে গেছে। স্কুল ও সরকারি গুদামেরও একই অবস্থা। সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে দ্রুত নতুন বইয়ের ব্যবস্থা করা না গেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানবিমুখতার পাশাপাশি শিক্ষাজীবন নিয়েও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। দ্রুত শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগী করতে প্রতিষ্ঠানগুলোয় আসবাবপত্রের ব্যবস্থা, খাবার ও ব্যবহারের পানির উৎস নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন অভিভাবক ও সচেতন মহল।

জেলা শিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বন্যায় সব প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিচতলা বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ইলেকট্রনিকস যন্ত্র, কম্পিউটার, নথিপত্র, চেয়ার, টেবিল, আলমিরা, নলকূপসহ সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের হিসাব মতে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা সংস্কারে অন্তত ৭০ কোটি টাকা প্রয়োজন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৯ লাখ টাকার। এছাড়া উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৩৫ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়; শিক্ষার্থীদের জন্য রাখা বইগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফী উল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, জেলায় বিশেষায়িত ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ৩৬১টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ১ লাখ ৬১ হাজার ৪৬  শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এর মধ্যে বন্যায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৯ শিক্ষার্থীর বই নষ্ট হয়ে গেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত ৩ কোটি টাকার সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে গেছে। ২৮ কোটি টাকার অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। আমরা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। আশা করি আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো যাবে।’

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, লোকালয়ে পানি ওঠার পর প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়ণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখন পর্যন্ত ২২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় তিন হাজার মানুষ আশ্রিত রয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে আশ্রিত মানুষ বাড়ি ঘরে গেছে; সেসব প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার করে পাঠদানের উপযোগী করে তোলা হচ্ছে।

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই সংকট নিরসন করে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ফেনীর প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে থাকা পাঠ্যবইসহ শিক্ষাসামগ্রী নষ্ট হয়েছে। কোনো শিক্ষার্থী যাতে ঝরে না পড়ে অথবা বিদ্যালয়বিমুখ না হয়, এজন্য আমরা দ্রুত পাঠদানের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে নতুন বই পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে।’

ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মো. শেখ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কলেজটি আট ফুট পানির নিচে ছিল। আসবাব, কাগজপত্রসহ অন্তত ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের নিচতলায় থাকা নয়টি ল্যাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আপাতত থিউরিক্যাল ক্লাসগুলো চালুর চেষ্টা করছি। তবে ল্যাবগুলো অকেজো হয়ে পড়ায় সব সেমিস্টারের প্রাকটিক্যাল কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের হোস্টেল, বই-খাতা, শিক্ষাসামগ্রী সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে সবাই চিন্তিত।’

সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দীন আহাম্মদ ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, জেলার সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা সংস্কার করে আগের জায়গায় ফিরে আসতে প্রায় ৩ কোটি টাকা প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগের অস্থায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন তারা।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ফেনীর ছয় উপজেলায় ৫৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭০ শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে ৯৭ হাজার ৫৫৩ জনের পাঠ্যবই নষ্ট হয়েছে।’

এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ইসরাত নুসরাত সিদ্দিকা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ফেনীর সব উচ্চবিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে অবকাঠামোগত অবস্থা স্বাভাবিক করতে প্রায় ২৮ কোটি টাকার প্রয়োজন। এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন