বিপ্লবকে তুলনা করা হয় প্রসব যন্ত্রণার সঙ্গে। পুরনোকে সরিয়ে নতুনের সংস্থাপনে প্রসব বটে। অনন্য সাধারণ সে অভিজ্ঞতা যখন কোনো জনপদের নিয়তি স্পর্শ করে, তখন কেবল সেখানকার সাধারণ মানুষ অনুরণিত হয় না; সংস্কৃতি, সাহিত্য আর শিল্পকলায় মুহুর্মুহু তরঙ্গায়িত হয় তার প্রতিধ্বনি। সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল মানুষই শিল্পচর্চায় ব্রতী হন। নিজেদের সৃষ্টিশীল সত্তা নিয়ে একীভূত হন জনপদের কান্না-হাসি, আন্দোলন ও সংগ্রামের স্রোতে। ফলে বিপ্লবের দিনগুলোয় শিল্প হয়ে ওঠে ভিন্ন ধারার দলিল।
‘বিপ্লব’ উচ্চারণের
সঙ্গে সঙ্গেই চোখে ভাসে ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতি। আঠারো শতকের শেষ দিকে ফ্রান্সের অস্থিরতায় পতন ঘটে সনাতনব্যবস্থা ও তার সুবিধাভোগীদের।
সে পটভূমিকে নিজেদের ভাষায় তুলে ধরেন ফরাসি চিত্রশিল্পীরা। এক্ষেত্রে সবার আগে স্মরণীয় নাম ইউজিন দেলাকোয়া, তিনি রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ফরাসি বিপ্লবের ঘটনাপঞ্জি। তার ‘লিবার্টি লিডিং দ্য পিপল’ পেয়েছে
আইকনিক মর্যাদা। চিত্রকর্মটিতে দেখা যায়, ফ্রিজিয়ান ক্যাপ পরিহিত এক নারীকে অনুসরণ
করে এগিয়ে চলছে মানুষ। তাদের হাতে ফ্রান্সের জাতীয় পতাকা ও বন্দুক। সম্মুখের
নারীটি স্বাধীনতার রূপক। ফরাসি বিপ্লবের জন্য অভূতপূর্ব মুহূর্ত ছিল ১৪ জুলাই বাস্তিলের
দুর্গ পতন। মুহূর্তটিকে নিজের কাজে তুলে ধরেছেন চিত্রকর জ্যাঁ বাতিস্তা লালমো। প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার কারণেই সম্ভবত তার চিত্রকর্ম অনেক বেশি জীবন্ত। তার আঁকা ‘দ্য স্টর্মিং অব দ্য বাস্তিল’-এ নিখুঁতভাবে ফুটে
উঠেছে সেদিনের ক্রুদ্ধ জনতার কোলাহল ও উত্তেজনার ছাপ।
ফরাসি বিপ্লবের বাকি শিল্পীদের মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন জ্যাঁ লুই ডেভিড ও পিয়ের আঁতোয়ান
দিমাশি। প্রথমজন পরিচিত ‘টেনিস কোর্ট ওথ’
আঁকার মধ্য দিয়ে এবং দ্বিতীয় জন অনবদ্য সৃষ্টি
‘উনে এক্সিকিউশনে ক্যাপিতালে’ নিয়ে।
দুটিই সে অস্থির সময়ের
গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
আমেরিকান বিপ্লব ফরাসি বিপ্লবের আগে হলেও সময়টা কাছাকাছিই ছিল। আমেরিকায় ১৩টি উপনিবেশ একযোগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। উত্তাল সে দিনগুলো বিভিন্ন সময় তুলে ধরেছেন বিভিন্ন চিত্রশিল্পী। সবচেয়ে পরিচিত চিত্রকর্ম জন ট্রামবুলের আঁকা ‘দ্য ডেথ অব জেনারেল মারসার অ্যাট দ্য ব্যাটেল অব প্রিন্সটন’। মূলত ট্রামবুল তার ওস্তাদ বেনজামিন ওয়েস্টের থেকে প্রভাবিত হয়ে আটটি চিত্রকর্মের একটা সিরিজ তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেন। আমেরিকান বিপ্লবকে ঘিরে আঁকা চিত্রকর্মগুলোর তিনটি এঁকেছেন শহীদদের স্মরণে, তিনটি বিজয় নিয়ে আর দুটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে কেন্দ্র করে। জীবনের বড় অংশটাই তিনি এ সিরিজ তৈরির পেছনে ব্যয় করেছেন। পরবর্তী জীবনে প্রতিটি কাজ নিয়েই তৈরি করেছেন ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ। এ সময়ের অন্য চিত্রশিল্পী থমাস সালি। জর্জ ওয়াশিংটনকে আঁকার প্রচেষ্টা থেকে শুরু হলেও তার কর্মক্ষেত্র ছড়িয়ে যায় সবকিছুকে। তার ‘প্যাসেজ অব দ্য ডেলওয়ারকে’ মনে করা হয় বিপ্লব নিয়ে তৈরি মাস্টারপিস। এদিকে চিত্রশিল্পী জন ব্ল্যাক হোয়াইটের আঁকা ‘জেনারেল ম্যারিয়ন ইনভাইটিং আ ব্রিটিশ অফিসার টু শেয়ার হিস মিল’ চিত্রকর্মে উঠে এসেছে বিপ্লবের ভিন্ন এক প্রতিচ্ছবি। অপ্রাসঙ্গিক হয় না লুই চার্লস অগাস্টিন কাউডারের ‘সিজ দ্য ইয়র্কটাউন’-এর কথা টানলে। যদিও চিত্রকর্মটি আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে ফ্রান্সের ভূমিকা উদযাপন করতে গিয়ে পরবর্তী সময় আঁকা। তার পরও দারুণ এক আবহ তৈরি করেছে।
মার্কিনি কিংবা ফরাসিদের তুলনায় রুশদের জন্য বিপ্লবের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকরা দখল করে নেয় শাসনক্ষমতা। এ ঘটনা বদলে দেয় বৈশ্বিক ব্যবস্থার সব সমীকরণ। রুশ বিপ্লবের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল সংস্কৃতির অঙ্গনেও। বিপ্লব নিয়ে আঁকা সবচেয়ে পরিচিত চিত্রকর্মের একটি ‘দ্য বলশেভিক’। ১৯২০ সালে চিত্রশিল্পী বোরিস কুস্তোদিয়েভ তৈরি করেন চিত্রকর্মটি। যেহেতু শিল্পী নিজে বিপ্লবের প্রথম দিন থেকেই জড়িত ছিলেন সক্রিয়ভাবে, তাই তার ছাপ দেখা যায় চিত্রকর্মে। তবে চিত্রশিল্পী ক্লিমেন্ট রেদকোর তুলি ভিন্নভাবে কথা বলেছে বিপ্লবের দিনগুলোয়। তার জ্বলন্ত দলিল ‘দ্য আপরাইজিং’। সাধারণত সোভিয়েত বিপ্লব হয়েছিল ধর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ১৯২৬ সালে রেদকোর আঁকা এ চিত্রকর্মে লেনিন যেন হয়ে উঠেছেন যিশু খ্রিস্ট। যিশুকে কেন্দ্রে রেখে যেভাবে তার চারপাশে সঙ্গীদের আঁকার একটা প্রবণতা ছিল অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মে। ঠিক সে কাজই করলেন রেদকো। লেনিনকে মাঝখানে রেখে চারপাশে এঁকেছেন ট্রটস্কি, ক্রুপস্কায়া, স্ট্যালিন ও অন্যদের। সোভিয়েত যুগের চিত্রশিল্পীদের মধ্যে পরিচিত মুখ আলেকজান্ডার দিয়েনকা। তিনি আধুনিকতাবাদকে বাস্তববাদের সঙ্গে মিশিয়েছিলেন নিজের কাজে। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজ ‘দ্য ডিফেন্স অব পেট্রোগ্রাদ’। চিত্রকর্মটিতে তিনি খুব সংক্ষিপ্তভাবে বিপ্লবকালীন সহিংসতার চক্রকে তুলে ধরেছেন। সেখানে রেড আর্মি ও হোয়াইট আর্মিকে দেখানো হয়েছে পৃথক লাইনে।
বিপ্লবের
ধারাপাতে ব্যতিক্রম নাম ইরানের ইসলামি বিপ্লব। সে আন্দোলনেও শিল্পীরা
শাহের শাসনের বিরোধিতা করে আন্দোলনে নিজেদের মতো করে তৈরি করে নিয়েছিলেন অবস্থান। তাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত কাজিম খালিফার আঁকা ‘আ গ্রেট ডে’।
সেখানে রেজা শাহ পাহলভির প্রতি মানুষের ক্ষোভকে তুলে ধরা হয়েছে। বিপ্লবের বারুদ নিয়েই খুসরাওজিরদি আঁকেন ‘ক্রাই আউট: দ্য ফার্স্ট নাইট অব মুহাররাম’। এছাড়া আব্বাস
আত্তার ও হাসান ইসমাইলজাদাহ
উপহার দিয়েছেন অনন্য কিছু নিদর্শন।
বিদ্রোহ আর গণ-আন্দোলনের কারণে ইতিহাসে বাংলার আরেক নাম দাঁড়িয়েছে বুলগাকপুর। এখানকার আন্দোলনমুখর জনতার সঙ্গে মিশেছে চিত্রশিল্পীদের কার্যক্রম। তাদের চিত্রকর্মে মানুষের দৈনন্দিন জীবন, অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিবাদ, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সমাজ সচেতনতা ও মুক্তির সংগ্রাম ওঠে এসেছে। এক্ষেত্রে সবার আগে আনা যায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নাম। মন্বন্তরের সময়ই তিনি তার চিত্রকর্ম দিয়ে শাসনযন্ত্রের প্রতি কটাক্ষ ছুড়ে দিয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অনুরণিত হয়ে তিনি আঁকেন ‘শরণার্থী’, যেখানে ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষের মুখ উঠে আসে। অনাগত কালের মানুষ এ ছবি দেখে সহজেই অনুমান করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে যাওয়াকে তিনি তুলে ধরেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামক স্কেচে। তবে গণ-আন্দোলনের প্রসঙ্গ এলে কামরুল হাসান প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন অন্যভাবে। বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ পোস্টার তৈরি করেন, যেখানে দেখা যায়, পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের রক্তপায়ী ও হিংস্র মুখ। ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আঁকেন ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ শিরোনামের স্কেচ। দুটিই বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আঁকা তার চিত্রকর্ম বেশুমার। প্রখ্যাত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীও স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে ছবি এঁকেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো ‘শহীদ’, ‘বাংলাদেশ ৭১’, ‘গণহত্যা-৭১’। আমিনুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘গণহত্যা’ নামে বড় তৈলচিত্র করেন। সেখানে দেখা যায় স্তূপাকৃতি হয়ে পড়ে থাকা অসংখ্য নর-নারীর কঙ্কাল। শাহাবুদ্দিন আহমেদের ‘ফ্রিডম ফাইটার’ চিত্রকর্মে দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধার দৃঢ় পদক্ষেপ। মুস্তফা মনোয়ারেরও কিছু দুর্লভ কাজ রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে, শওকত ওসমানের উপন্যাস ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’-এর জন্য বেশকিছু স্কেচ করেন তিনি। অপেক্ষাকৃত তরুণ শিল্পী রফিকুন নবী ঢাকায় অবরুদ্ধ ছিলেন। তিনি আঁকেন ‘বিজয়’ নামের চিত্রকর্ম। ১৯৭১ সালের আগস্টে এ চিত্রের কাজ শুরু করেন আর শেষ করেন একই সালের ১৬ ডিসেম্বর।
প্রতি
গণ-আন্দোলন জোয়ারের মতো প্লাবিত করে মানব চিন্তার প্রতিটি ক্ষেত্র। কেবল সমকালে নয়, ভবিষ্যতের শিল্পীদেরও অনুপ্রাণিত করে নতুন সৃষ্টিতে। ফলে
বাড়তে থাকে শিল্পের সারি। ঐতিহাসিক বাস্তবতা শিল্পীর মননে বহুমাত্রিক অর্থ লাভ করে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শিল্পীরা তাদের তুলির আঁচড়ে লিখে রেখে যান সে অভ্যুত্থানের ডায়েরি।