শিশুদের কিডনি রোগ

বড়দের পাশাপাশি শিশু কিডনি রোগীও বাড়ছে

অধ্যাপক ডা. সনৎ কুমার বড়ুয়া

ছবি: জিএম

সুস্থতার জন্য কিডনির সুস্থতা জরুরি। বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে দেশে ৪০-৫০ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে, যাদের বেশির ভাগেরই বয়স -১০ বছর। বিভিন্ন বয়সে শিশুদের ভিন্ন ভিন্ন কিডনির সমস্যা হয়। যেমন

. নবজাতক শিশু কিডনি মূত্রনালির নানা জন্মত্রুটি নিয়ে জন্মাতে পারে, যেমন একটি কিডনি থাকা, বিভিন্ন আকারের কিডনি অর্থাৎ ছোট-বড় থাকা, ঠিক জায়গায় না থাকা, সরু মূত্রনালি, মূত্রনালিতে পর্দা থাকা।

. নেফ্রোটিক সিনড্রোমে থেকে ১০ বছরের শিশুরা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এতে শিশুদের মুখ চোখের পাতার চারপাশ ফুলে যায়, প্রস্রাব কমে যায়, পরবর্তী সময়ে দিন থেকে পাঁচদিনের মধ্য সারা শরীরে পানি আসে।

. এক থেকে তিন বছরের শিশুর একনাগাড়ে জ্বরের কারণ হতে পারে মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ। শিশুর ওজন না বাড়া, ডায়রিয়া, বমি এসব উপসর্গও থাকতে পারে। অনেকক্ষণ টয়লেট আটকে রাখলে বা কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনি মূত্রনালির নানা জন্মত্রুটি থাকলে মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ বেশি হয়। বারবার সংক্রমণ হলে কিডনিতে স্থায়ীভাবে কিছু জটিলতা তৈরি হয়, যা থেকে পরবর্তী সময়ে উচ্চ রক্তচাপ কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

. থেকে ১৪ বছরের স্কুলগামী শিশুরা অ্যাকুইট গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়। খোসপাঁচড়া, বা গলাব্যথায় আক্রান্ত হওয়ার দুই-তিন সপ্তাহ পর সারা শরীর ফুলে যায়, প্রস্রাবের রঙ লাল হয়। এছাড়া জটিলতা হিসাবে খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট অ্যাকুইট কিডনি ইনজুরি হতে পারে।

শিশুদের কিডনি রোগের লক্ষণ

            সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর চোখের পাতা মুখ ফুলে যাওয়া, পা ফুলে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া।

            প্রস্রাবের অস্বাভাবিক রঙ যেমন গাঢ় লাল, চা বা কফির মতো রঙ

            প্রস্রাব হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া বা ঘণ্টা পর্যন্ত না হওয়া

            ঘন ঘন প্রস্রাব করা, অস্বাভাবিক দুর্গন্ধ, জ্বালাপোড়া, পেট ব্যথা, বমি, জ্বর ইত্যাদি

            কিছুদিন পরপর জ্বর হওয়া

            পাঁচ বছরের অধিক বয়সের পরও বিছানায় প্রস্রাব করা

            বয়স অনুপাতে শারীরিক বৃদ্ধি না হওয়া, কম বয়সে উচ্চ রক্তচাপ

            জন্মের পর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় প্রস্রাব করা, ছেলেদের প্রস্রাব দূরে না যাওয়া, প্রস্রাব করার সময় অতিরিক্ত কান্নাকাটি করা

            কিডনিতে পানি জমা

            পেটের এক বা উভয় পাশে বা তলপেট ফুলে যাওয়া

এসব লক্ষণ দেখা গেলে, পরিবারের কারো কিডনি রোগ থাকলে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

 শিশুদের কিডনি ইনজুরি বা কিডনি বিকল হওয়া

কিডনি ইনজুরি সাধারণত দুই ধরনেরঅ্যাকুইট কিডনি ইনজুরি বা ক্রনিক/দীর্ঘমেয়াদি কিডনি ইনজুরি। নিম্নলিখিত কারণে শিশুদের অ্যাকুইট কিডনি ইনজুরি হতে পারে

            ডায়রিয়া, দীর্ঘক্ষণ বমি বা অতিরিক্ত রক্তপাত

            কিছু নেফ্রোটক্সিক ওষুধের কারণে

            কিডনির নিজস্ব কিছু রোগের কারণে

            হিমোলাইটিক ইউরমিক সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত শিশু

নিম্নলিখিত কারণে শিশুদের ক্রনিক/দীর্ঘমেয়াদি কিডনি ইনজুরি হতে পারে

            বারবার মূত্রনালিতে সংক্রমণ বা দীর্ঘদিন মূত্রনালিতে বাধার ফলে প্রস্রাব পরিষ্কার না হলে

            প্রস্রাবে প্রোটিন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকলে

            আগে অ্যাকুইট কিডনি ইনজুরি হলে এবং তা সঠিক নিয়মে ফলোআপ না করালে

            জিনগত কিডনি রোগ থাকলে

রোগ নির্ণয়: শিশুদের কিডনি রোগ শনাক্ত যথাযথ চিকিৎসার জন্য একজন দক্ষ শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমে প্রস্রাব পরীক্ষা করা হয়। রোগের উপসর্গ অনুযায়ী ইউরিন কালচার, ইউরিন প্রোটিন পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া রক্ত পরীক্ষায় অ্যালবুমিন, কোলেস্টেরল, ইলেকট্রোলাইট, ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া, ক্যালসিয়াম, ফসফেট আলট্রাসাউন্ড কিডনি বায়োপসি পরীক্ষা করা হয়।

চিকিৎসা: কিডনি রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে তা কোন পর্যায়ে আছে বা কী কারণে হয়েছে। জন্মগতভাবে বা বংশগত কারণে যেসব কিডনি রোগ হয়, তার মধ্যে কিছু কিছু রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে অপারেশন করা হয়। তবে এদের মধ্যে বারবার মূত্রনালির সংক্রমণ ঝুঁকিতে থাকায় লম্বা সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হয়।

ডায়রিয়ার কারণে কিডনি সমস্যা হলে সঠিকভাবে পানিশূন্যতা এবং রক্তের লবণের পরিমাণ ঠিক করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি কিডনি ইনজুরি হলে ওষুধের সাহায্যে জীবনযাত্রা পরিবর্তন করলে উপকার পাওয়া যায়। তবে শেষদিকে ডায়ালাইসিস কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন হয়।

শিশুদের কিডনি রোগ প্রতিরোধে করণীয়

 শিশুকে পরিমিত পরিমাণ পানি খাওয়ান, বিশেষ করে ডায়রিয়া বা জ্বর হলে বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়ান

 শিশুদের শরীরে খোসপাঁচড়া বা গলাব্যথা হলে তা অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া উচিত

 অপ্রয়োজনীয় ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ বিশেষ করে ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা থেকে বিরত থাকা উচিত

 শিশুর খাদ্য তালিকায় প্যাকেট জাতীয় খাবার পানীয় নিয়ন্ত্রণ করা

 শিশুর প্রস্রাব কম হলে বা শরীর ফুলে গেলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া

 শিশুদের প্রস্রাবের সঙ্গে ব্যথাযুক্ত বা ব্যথাহীনভাবে রক্ত গেলে সঙ্গে সঙ্গে শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে

 অযথা টয়লেট চেপে না রাখা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে শিশুদের মূত্রনালির সংক্রমণ অনেকাংশে কমে যায়

লেখক: অধ্যাপক, পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি বিভাগ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন