ভূরাজনৈতিক উত্তেজনায় রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছবে স্বর্ণের দাম

বণিক বার্তা ডেস্ক

উচ্চ সুদহার থাকা সত্ত্বেও চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ছবি: দ্য স্ট্রেইট টাইমস

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ সুদহার বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে সাধারণত স্বর্ণে বিনিয়োগ কমিয়ে অন্যান্য স্থায়ী পরিসম্পদে (বন্ড বা শেয়ার) বিনিয়োগ বাড়ান ব্যবসায়ীরা। তবে কয়েক বছর ধরে বিশ্বজুড়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ার প্রভাবে স্বর্ণের দাম বাড়ছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ মূল্যবান ধাতবটির দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছতে পারে। খবর দ্য স্ট্রেইট টাইমস। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে স্বর্ণ আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৩০০ ডলারে বেচাকেনা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে কিছুদিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে সুদহার কমানোর ঘোষণাও দিতে পারে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ। এর প্রভাবে ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে স্বল্পমেয়াদে স্বর্ণের বাজারদর আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৪০০ ডলার থেকে ২ হাজার ৫০০ ডলারে উন্নীত হতে পারে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংকের মার্কেট স্ট্র্যাটেজি বিভাগের প্রধান হেং কুন বলেন, ‘ফেড (ফেডারেল রিজার্ভ) সুদহার কমালে গোল্ড ইটিএফ (এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড ফান্ডস) ক্রয় বা স্বর্ণের বিপরীতে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এতে ধাতবটির দাম নতুন উচ্চতায় পৌঁছতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৪০০ ডলার ও চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ২ হাজার ৫০০ ডলারে উন্নীত হতে পারে।’ এছাড়া ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রতি প্রান্তিকে ধাতবটির দাম ১০০ ডলার করে বাড়ার পূর্বাভাস দেন হেং কুন। 

অন্যদিকে ওসিবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভাসু মেনন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো ক্রমেই দুর্বল অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থার উন্নতিতে সেপ্টেম্বর নাগাদ সুদহার কমাতে পারে ফেড। তাছাড়া ডিসেম্বরেও আরেক দফা সুদহার কমানোর ঘোষণা আসতে পারে। এতে স্বল্পমেয়াদে স্বর্ণের দাম স্থিতিশীল থাকতে পারে।’ 

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়, কভিড-১৯ মহামারী, চীনের নিম্নমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কারণে গত কয়েক বছর ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বেড়ে চলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে অতিডানপন্থী রাজনীতির উত্থান উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এটিও স্বর্ণের দাম বাড়ায় প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন ভাসু মেনন। তিনি বলেন, ‘স্বর্ণকে যেকোনো অনিশ্চয়তার বিপরীতে নিরাপদ গ্যারান্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সব মিলিয়ে ধাতুটির দাম গত সাত বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।’ 

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের গোল্ড মিড-ইয়ার আউটলুক ২০২৪ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত স্বর্ণের মূল্য ১৪ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে অন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিসম্পদ যেমন বন্ড, শেয়ারের মূল্য এত বাড়েনি। 

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার ফলে স্বর্ণের দাম বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও এটি কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে এশিয়ার দেশগুলোয় স্বর্ণের মুদ্রা, বার ও গোল্ড ইটিএফের চাহিদা বাড়ায় মূল্যবান ধাতবটিতে বিনিয়োগ বেড়েছে। 

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের গবেষণাপ্রধান জুয়ান কার্লোস আর্তিগাস জানান, স্বর্ণের দামের ব্যাপারে সাধারণত সুদহার ও ডলারের দাম পর্যবেক্ষণ করা হয়। গত ছয় মাসে উচ্চ সুদহার থাকা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা গেছে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে স্বর্ণের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। 

স্বর্ণের এমন মূল্যকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ব্যতিক্রম বলে মনে করেন ডিবিএস ব্যাংকের বিনিয়োগ কুশলী গোহ জুন উং। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডের বিপরীতে লাভের পরিমাণ বেশি হলে স্বর্ণের বিনিয়োগ কমে আসে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এমন বিপরীতমুখী সম্পর্কই দেখা যায়। কিন্তু এ বছর বিশ্বজুড়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে উল্টো পরিস্থিতি দেখা গেছে।’ 

এদিকে মূল্যস্ফীতি কমলেও স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলেও মনে করেন ভাসু মেনন। তিনি বলেন, ‘স্বর্ণ স্থায়ী আমানতের মতো মুনাফা প্রদান করে না। তাই সুদহার কমানো হলেও স্বর্ণের চাহিদা বাড়বে। ফলে তখনো ধাতবটির দাম বাড়তে থাকবে। তবে ডলারের দাম কমলে স্বর্ণ আরো সাশ্রয়ী মূল্যে কেনা যাবে। তখন ব্যবসায়ীরা আরো বেশি স্বর্ণ কিনতে আগ্রহী হবেন।’

ভাসু মেনন বলেন, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে ডলারের অবনমন ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ বাড়ানোর কারণে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো স্বর্ণের মজুদ বাড়াচ্ছে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের মতে, ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বৈশ্বিক স্বর্ণের চাহিদায় ১০ শতাংশ অবদান রেখেছিল। চলতি বছর এ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর অবদান প্রায় ৫ শতাংশের মতো। 

মেনন বলেন, ‘স্বর্ণের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় কিছুদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ধাতবটি কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তবে ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক অস্থিতিশীলতার কারণে এটি সামনের দিনে আরো বাড়বে বলে ধারণা করা যায়।’

বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ক্যাজেনোভে ক্যাপিটালের চিফ ইনভেস্টমেন্ট অফিসার ক্যাসপার রক অবশ্য বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পক্ষে। তার মতে, বিদ্যমান সুদহারেও স্বর্ণ প্রত্যাশার চেয়ে ভালো পারফর্ম করছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি কোনোভাবেই টেকসই প্রবণতা হতে পারে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন