লোডশেডিংয়ে শিল্প-কারখানার অচলাবস্থা

শিল্পোৎপাদন অব্যাহত রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার অপরিহার্য। চাহিদার অনুপাতে বিদ্যুতের সরবরাহ কমে গেলে ঘন ঘন ও দীর্ঘ সময় ধরে লোডিশেডিং হয়। ফলে জনজীবন যেমনি বিপর্যস্ত হয়, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উৎপাদন খাত। বিশেষ করে শিল্প-কারখানায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়; উৎপাদন কমে যায়। উৎপাদন কমে গেলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে আসে। শিল্পোৎপাদন অব্যাহত রাখা তাই অতীব জরুরি। এজন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা।

দেশে গত দুই বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বেড়েছে দফায় দফায়। গ্যাসের দামও গ্রাহক পর্যায়ে গত দুই বছরে বাড়ানো হয়েছে দুবার। আর শিল্প খাতে ক্যাপটিভে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম চলতি বছর দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। আবার বিদ্যুতের দাম গত বছর বেড়েছে তিন দফা। এরপর চলতি বছরের মার্চে তা আরো এক দফা বাড়ানো হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামে ঊর্ধ্বমুখিতা বজায় থাকলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়েনি। উল্টো বেড়েছে লোডশেডিং। বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিদিন ৪০০ থেকে প্রায় ৮৫০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি লোডশেডিং করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। মধ্যরাতে লোডশেডিং হচ্ছে বেশি। ওই সময় গড়ে ৭০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি লোডশেড দিতে হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় বরাবরই সমন্বয় বা লোডশেডিং করে চলতে হয় বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। সাড়ে তিন-চার হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিংও করতে হয়েছে। যদিও বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ক্রমে বাড়ছে। 

দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট। সেখানে বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ৪৬ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে টাকা যাচ্ছে সরকারের তহবিল থেকে। সম্প্রতি ৷বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বাজেট বরাদ্দ নিয়ে এক আলোচনা সভায় এসব তথ্য তুলে ধরে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

ওই আলোচনা সভায় আরো বলা হয়, সরকার এখন যে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করেছে, তা ২০৩০ সালেও প্রয়োজন হবে না। আজ থেকে ছয় বছরে চাহিদা দাঁড়াতে পারে ১৯ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। ২৫ শতাংশ রিজার্ভ ধরলে তখন ২৩ হাজার ২৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। সক্ষমতা বাড়লেও এখনো দেশে গরমে গড়ে ১১০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে।  

সক্ষমতা বাড়লেও বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার অন্যতম কারণ প্রাকৃতিক গ্যাস সংকট। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য জ্বালানি এই গ্যাস। গ্যাসের অভাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেক সক্ষমতা বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। একসময় বাংলাদেশের বিদ্যুতের ৮০ শতাংশ উৎপাদন হতো প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে, বর্তমানে তা ৪৬ শতাংশে নেমেছে। এর অন্যতম কারণ দেশীয় গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো এবং নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যানুযায়ী, দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১২ হাজার ২১৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ ছয় হাজার মেগাওয়াট। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ৬ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট। সেখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট। তরল জ্বালানির সক্ষমতা ছয় হাজার মেগাওয়াট থাকলেও গড়ে সেখান থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসছে গড়ে ৫০০ মেগাওয়াট। এক হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে।

দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত আমদানিনির্ভর হওয়ায় বিদ্যুৎ সংকট বর্তমানে আরো তীব্র হয়েছে। নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার না করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে আমদানিনির্ভর। গত ১০ বছরে বড় কোনো মজুদ আবিষ্কার করা যায়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, জ্বালানি আমদানির জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বহুগুণে বেড়ে গেছে, কিন্তু বিপরীতে সক্ষমতা কমেছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ৮৬ পয়সা। ফলে দিন দিন পিডিবির অর্থ সংকটও তীব্র হচ্ছে। সময়মতো বিল পরিশোধ না করায় এখন কমেছে আমদানীকৃত বিদ্যুতের পরিমাণ। জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য ও ডলার সংকটের কারণে আমদানি এবং উৎপাদন উভয়ই ব্যাহত হচ্ছে।

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যা দূর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করা জরুরি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যয় কমিয়ে এবং দুর্নীতি ও অপব্যয় রোধ করার মাধ্যমে এ সংকটময় পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সহায়ক হতে পারে গ্যাসের উত্তোলন বৃদ্ধি। সেক্ষেত্রে গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানে আমাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন যেমন বাড়ানো সম্ভব হবে, তেমনি গ্যাস সংকটও দূর হবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি আধুনিক জ্বালানি নীতিমালা তৈরি। জোড়াতালি দিয়ে পরিকল্পনা না করে সমন্বয় প্রয়োজন। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে একের পর এক পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে কেবল উৎপাদন সক্ষমতা ও ব্যয় বাড়ছে, হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে, উৎপাদন বাড়ছে না। 

বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানো না গেলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের সিংহভাগ শিল্প-কারখানা মুখ থুবড়ে পড়বে। এ খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বিদ্যুৎ সংকট, যেটি এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উৎপাদন খাত সমৃদ্ধ করতে ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করার বিকল্প নেই। যে সক্ষমতা আছে, তা থেকেই সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করাকে এমন সংকটাপন্ন সময়ে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলেই প্রতীয়মান হয়। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন