কূপ খননে সুফল মিলতে শুরু করেছে

কৈলাসটিলা ৮-এ মিলল গ্যাস, দৈনিক যুক্ত হবে ২১ মিলিয়ন ঘনফুট

আবু তাহের

ছবি : বণিক বার্তা

সিলেটের কৈলাসটিলা গ্যাস ক্ষেত্রের ৮ নম্বর কূপে (কৈলাসটিলা-৮) গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স। এ ‍কূপ থেকে প্রতিদিন ২১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। ‘গ্যাস গ্যাদারিং পাইপলাইন’ নির্মাণ করে আগামী তিন মাসের মধ্যে এ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করবে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় উৎস থেকে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে পেট্রোবাংলা যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, তা থেকে সাফল্য মিলতে শুরু করেছে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর আওতাধীন গ্যাসফিল্ড থেকে জাতীয় গ্রিডে বাড়তি ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট যুক্ত হবে। এজন্য ৪৮টি কূপ খননের কার্যক্রম চলছে। এসব কূপের মধ্যে অনুসন্ধান কূপ, মূল্যায়ন কূপ ও পরিত্যক্ত কূপ রয়েছে। এরই মধ্যে ১৫টি কূপ খননে দৈনিক ১৪৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে পেট্রোবাংলা। যদিও এখন পর্যন্ত গ্রিডে ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করতে পেরেছে সংস্থাটি।

কৈলাসটিলা-৮ কূপে গ্যাস পাওয়ার আগে নোয়াখালীর সুন্দলপুর গ্যাস ক্ষেত্রের ৩ নম্বর কূপে গ্যাসের সন্ধান পায় বাপেক্স। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সিলেট-১০ কূপে গ্যাস পাওয়ার কথা জানায় জ্বালানি বিভাগ। এ কূপ থেকে গ্রিডে দৈনিক ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হবে। এই গ্যাসকূপ খনন করে তেলের সন্ধানও পাওয়া যায়।

পেট্রোবাংলার তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, গ্রিডে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করার যে পরিকল্পনা, তাতে বাপেক্সের ২০টি কূপ থেকে আসবে ২৮১ মিলিয়ন ঘনফুট। ১৫২ মিলিয়ন ঘনফুট আসবে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ১৩টি কূপ থেকে। সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিএফএল) ১৫টি কূপ থেকে মিলবে ১৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট।

গ্যাসকূপ খনন ও কূপের ওয়ার্কওভারের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ১৪৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসপ্রাপ্তির মধ্যে ভোলা নর্থ-২ থেকে দৈনিক ২০ এমএমসিএফ, টগবি-১ থেকে ২০ এমএমসিএফ, ইলিশা-১ থেকে ২০ এমএমসিএফ, তিতাস-২৪ থেকে সাড়ে ৮ এমএমসিএফ, বিয়ানীবাজার-১ থেকে সাড়ে ৯ এমএমসিএফ, কৈলাসটিলা-২ থেকে ৭ এমএমসিএফ, সিলেট-১০ থেকে ২৫ এমএমসিএফ ও রশিদপুর-২ থেকে ৮ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। সুন্দলপুর-৩ নম্বর কূপে গ্যাস পাওয়া গেলেও পরিমাণ নিশ্চিত করেনি বাপেক্স।

দেশে গ্যাসের মজুদ ক্রমেই কমে আসছে। ঘাটতি মেটাতে আমদানি করা হচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। তবে বিশ্ববাজারে পণ্যটির মূল্য স্থিতিশীল নয় বলে আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে জোর দিয়েছে পেট্রোবাংলা। ৪৮টি কূপ খননের পাশাপাশি ২০২৮ সালের মধ্যে আরো ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে পেট্রোবাংলার।

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর আওতায় বড় আকারে খনন কার্যক্রম চলছে। আরো ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে। কূপ খননে গ্যাসপ্রাপ্তির সাফল্য অনেক ভালো। আশা করি জাতীয় গ্রিডে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গ্যাস যুক্ত করা যাবে।’

কৈলাসটিলা গ্যাসের সন্ধান নিয়ে গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়,  কৈলাসটিলা-৮ কূপের নতুন গ্যাস স্তর হরাইজোন-৪-এ ৩ হাজার ৪৩৮-৩ হাজার ৪৪৭ মিটার গভীরতায় গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। কূপটিতে প্রাথমিকভাবে গ্যাসের মজুদ রয়েছে ২৫-৪০ বিলিয়ন ঘনফুট, যার বাজারমূল্য ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। প্রতি ঘনমিটার ২২ টাকা ৮৭ ধরে এ দাম নির্ধারণ করেছে মন্ত্রণালয়। তবে পুরো কৈলাসটিলায় উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ রয়েছে ১ হাজার ৯০০ বিসিএফ বলে প্রতিবেদনে ‍জানানো হয়।

কৈলাসটিলা-৮ কূপের গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হলে গ্যাস ক্ষেত্রটির মোট সক্ষমতা দাঁড়াবে দৈনিক ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমান উৎপাদন প্রায় ২৯ মিলিয়ন ঘনফুট।

কৈলাসটিলা-৮ কূপ খননে বিজয়-১২ রিগ ব্যবহার করে বাপেক্স। গত ১১ জানুয়ারি এ কূপ খনন শুরু হয়। প্রায় সাড়ে চার মাসের মাথায় এ কূপে গ্যাসের সন্ধান পেল রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিটি। 

কৈলাসটিলা গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় ১৯৬২ সালে। গ্যাস উত্তোলন শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। মজুদ সক্ষমতার দিক থেকে দেশের চতুর্থ বৃহত্তম গ্যাস ক্ষেত্র কৈলাসটিলা।

হাইড্রোকার্বন ইউনিট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মজুদের হিসাব (২পি) অনুসারে কৈলাসটিলায় ২ হাজার ৮৮০ বিসিএফ গ্যাস রয়েছে। এর মধ্যে উত্তোলন হয়েছে ৮০০ বিসিএফের কিছু বেশি (জানুয়ারি, ২০২৪ পর্যন্ত)। এখনো মজুদ রয়েছে প্রায় ২ হাজার ১০০ বিসিএফ। বর্তমানে কৈলাসটিলার সাতটি কূপ থেকে দৈনিক প্রায় ২৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস গ্রিডে যুক্ত করছে এসজিএফএল। 

দেশের অন্যান্য  গ্যাস ক্ষেত্রে যে পরিমাণ কূপ খনন হয়েছে, মজুদ সক্ষমতার হিসেবে কৈলাসটিলায় সে পরিমাণ কূপ খনন করা যায়নি। ফলে বিপুল মজুদ থাকার পরও গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যায়নি। গ্যাস সংকটের মধ্যে উৎপাদন সক্ষমতায় কৈলাসটিলার পিছিয়ে পড়াকে বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন জ্বালানিবিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানিবিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কৈলাসটিলা গ্যাস ফিল্ডে কূপ খনন করে নতুন গ্যাস পাওয়া গেছে, এটা ভালো খবর। তবে ফিল্ডটির মজুদ বিবেচনায় এখনো আরো বেশি কূপ খনন প্রয়োজন। এই ফিল্ডের বিষয়ে দীর্ঘদিন সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে গ্যাস থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন বাড়ানো যায়নি। অন্যান্য ফিল্ডের চেয়ে এখানে জ্বালানি বিভাগের বেশি নজর দেয়া উচিত। তাহলে গ্যাসের ঘাটতির বড় অংশ এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে।’

খনন শুরু হওয়া ৪৮টি কূপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্যাস মিলেছে কৈলাসটিলায়। এখানে গ্যাসের চাপও অন্যান্য কূপের তুলনায় বেশি। এর আগে, ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর সিলেট গ্যাস ক্ষেত্রের ১০ নম্বর কূপে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। যেখান থেকে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ ব্যারেল হারে জ্বালানি তেল পাওয়ার কথা জানায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। 

সিলেট-১০ নম্বর গ্যাসকূপে ২ হাজার ৫৭৬ মিটার গভীরতায় খনন সম্পন্ন হয়। কূপটিতে তিনটি স্তরে গ্যাসের উপস্থিতি পায় এসজিএফএল। এর মধ্যে সবচেয়ে নিচের স্তরটি ২ হাজার ৫৪০ থেকে ২ হাজার ৫৫০ মিটার পর্যন্ত পরীক্ষা করে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রবাহ পাওয়া যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন