যেখানে মূর্ত অক্ষর ও মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাস

মাহমুদুর রহমান

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা বাংলা অক্ষর, লেটার প্রেস চালিয়ে দেখাচ্ছেন হালিম হোসেন ছবি: মাসফিকুর সোহান

বৈশাখের নিদাঘের মাঝে হঠাৎই শীতল হাওয়া। বিকালে মনোরম পরিবেশ। মেঘে ঢাকা আকাশ আর তার মধ্যে মৃদু বিজলির ঝলকানি। এসব দেখা যাচ্ছিল আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার লা গ্যালারির দরজার ওপারে। চত্বরে তখন কেউ কেউ আড্ডা দিচ্ছেন। আর গ্যালারির ভেতরে বাংলা অক্ষরের ইতিহাস, শিশুশিক্ষার বই আর মুদ্রণের ইতিহাসের নানা অনুষঙ্গের জীবন্ত উপস্থিতি। জড় বস্তুরও জীবন্ত উপস্থিতি হয় তা বোঝা গেল বাংলা প্রাইমার নিয়ে সব্যসাচী হাজরার প্রদর্শনী ‘প্রাইমার টু প্রেস’ প্রদর্শনীতে। সব্যসাচী হাজরা বাংলা বর্ণমালা নিয়ে তার বিস্তৃত গবেষণা থেকে লিখেছেন ‘বর্ণমালা: বাংলা বর্ণ পরিচয়’। সেই সঙ্গে বাংলা বর্ণ ও মুদ্রণের ইতিহাস তুলে ধরতে আয়োজন করেছেন একটি প্রদর্শনীর।

কী আছে এ প্রদর্শনীতে। গ্যালারির ক্যাফে-দরজা পার করে ঢুকলে প্রথমেই দেখা যাবে বর্ণকে পরিচয় করিয়ে দেয়া বইয়ের প্রচ্ছদ। আছেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামসুন্দর বসাক প্রমুখ। শিশুশিক্ষা, সহজ পাঠ, বাল্যশিক্ষা প্রভৃতি বইয়ের প্রচ্ছদ, ভেতরের লেখা, ছড়া উপস্থাপন করা হয়েছে গ্যালারির দেয়ালে। সেখানে দেখা যায় অক্ষরের নানা রূপ। ধরা যাক মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষার কথা। দেয়ালে রাখা বিশাল ফ্রেমে ক থেকে ক্ষ, অ থেকে ঔ পর্যন্ত বর্ণের পাশাপাশি রাখা আছে প্রাণী ও বস্তুর ছবি। অক্ষরের সঙ্গে প্রকৃতিকে মেলানো যায়। শিশুদের অক্ষর শেখাতে এর জুড়ি নেই।

আরেকটি ফ্রেমে দেখা যায় বাল্যশিক্ষা থেকে একটি পাতা। সেখানে ম-ফলার ব্যবহার দেখানো হয়েছে। এমন প্রতিটি ফ্রেমেই পুরনো দিনের অক্ষর, অক্ষরশিক্ষার পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। দেয়ালে ফ্রেম করা এসব ছবির পাশাপাশি গ্যালারির একদিকে কাচে ঢাকা আরো কিছু বইয়ের পাতা। সেখানে আছে বাল্যশিক্ষার প্রচ্ছদ। এছাড়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত বর্ণপরিচয়ের বর্ণগ্রাফি। 

কেন এমন প্রদর্শনী? এমন জিজ্ঞাসা ছিল সব্যসাচী হাজরার কাছে। তিনি বলেন, ‘২০০ বা ২৫০ বছর ধরে বাঙালি যে অক্ষরজ্ঞান শিখল, বাঙালির প্রথম পড়া বই যা থেকে সে শিখল, সেই পরম্পরাটা ধরে রাখতে চেয়েছি। এটার আসলে একটা ইতিহাস আছে। শিশুশিক্ষা পড়েছেন আমার দাদু, বর্ণ পরিচয় পড়েছেন আমার বাবা। আমি আদর্শলিপি পড়েছি আর আমার মেয়ে পড়ছে সহজ পাঠ। এ বইগুলোর মধ্যে সে সময়কার সংস্কৃতি, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট আছে। এটা আমাদের নতুন প্রজন্মের জানা উচিত।’ 

সেই জানানোর ইচ্ছা বা প্রয়োজন থেকেই বই করার পরিকল্পনা ছিল সব্যসাচী হাজরার। কিন্তু বই সংকলন করার পর তার মনে হলো কেবল এখানেই শেষ করা যায় না বা এটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা সম্ভব না। অক্ষরের সঙ্গে মুদ্রণের একটা বড় সংযোগ আছে। তিনি সেটাও দেখাতে চাইলেন। এ প্রদর্শনীতে হাজরা নিয়ে এসেছেন মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসও। গুটেনবার্গ থেকে লেটার প্রেস, ব্লক প্রিন্টিং, তার নানা ছোট-বড় ডিটেল পাওয়া যায় এ প্রদর্শনীতে।

লা গ্যালারির মধ্যখানে কাচে ঢাকা চেম্বারের মধ্যে সাজানো কাঠের ব্লক। উল্টো অক্ষরগুলো পাল্টে দিলেই কাগজে পড়ে তার ছাপ। তৈরি হয় অক্ষর, তৈরি হয় লেখা। কাঠের ব্লক রাখার পাশাপাশি তা থেকে ছাপা অক্ষরও রাখা হয়েছে যেন বোঝা যায় কীভাবে অক্ষর ছাপা হয় ব্লক থেকে। মুদ্রণ শিল্পের মোটামুটি একটা ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় এ প্রদর্শনীতে। তা আরো মূর্ত হয়েছে হালিম হোসেনের লেটার প্রেসের মাধ্যমে।

লেটার প্রেস একটা দীর্ঘ সময় মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। এখনো হালিম হোসেন নীলক্ষেতে লেটার প্রেসে মুদ্রণ করেন। ‘প্রাইমার টু প্রেস’ প্রদর্শনীতে হালিম হোসেন একটি লেটার প্রেসে মুদ্রণ করে দেখাচ্ছিলেন দর্শনার্থীদের। হাতে চালানো যন্ত্রটি একটি প্রেট থেকে কালি এনে ট্রেতে রাখা কাগজে ফুটিয়ে তুলল অক্ষর। হালিম হোসেন জানালেন, এখনো বাংলাদেশে কয়েকটি লেটার প্রেস আছে। কম হলেও কাজ হয় লেটার প্রেস দিয়ে। অক্ষর সন্নিবেশ করে কাজ করতে তিনি পছন্দ করেন। 

হালিম হোসেনের পেছনেই লেটার প্রেসের নানা সরঞ্জাম সাজানো আছে কাচের বাক্সে। সেখানে দেখা যায় লেটার প্রেস ইংকের টিনের বাটা, কালি ছড়িয়ে দেয়ার রাবার রোলার, কালি মেশানোর গ্লাস, চেস, ইংক নাইফ, টুইজার ইত্যাদি। সব্যসাচী হাজরা জানালেন, এসবই তিনি সংগ্রহ করেছেন বাংলাদেশ থেকে। লেটার প্রেস এখনো চালিয়ে যাওয়া হালিম হোসেনকেও পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন। আর যন্ত্রপাতির কোনটির কী কাজ তাও দর্শনার্থীদের জানিয়ে দেবেন হালিম হোসেন।

আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে চলমান ‘প্রাইমার টু প্রেস’ দর্শনার্থীদের নিয়ে যাবে বাংলা অক্ষর শেখার পুরনো দিনে। অক্ষরশিক্ষার আটটি বই, তার ইতিহাস ছাড়াও অল্প সময় ও আয়াসে মুদ্রণের বেশকিছু বিষয়ের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে এখানে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন