ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী

ছোটবেলা থেকেই নিজের পড়াশোনা নিজেই চালান টনি

ফিচার প্রতিবেদক

টনি ত্রিপুরা ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বাড়ি থেকে স্কুল বেশ দূরে। অসচ্ছল পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা। পড়াশোনার খরচ চালাতে না পারায় দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের এক শিক্ষকের কাছে পড়তে হয়। এরপর মামাবাড়ি গিয়ে সেখানে একটি নির্দিষ্ট সময় কাজ করে তারপর পড়তে হতো। এভাবে কোনো রকম স্কুলের গণ্ডি পেরোন। এইচএসসিতে নটর ডেম কলেজে পড়াশোনা করে স্নাতকে চান্স পেয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি)। জীবনের এ গল্প জাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী টনি ত্রিপুরার।

টনি ত্রিপুরার জন্ম পার্বত্য চট্টগ্রামের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের টংঝিরি গ্রামে। কয়েক কিলোমিটার পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া অন্যদের জন্য কঠিন হলেও সম্ভব ছিল কিন্তু টনির জন্য ছিল অসম্ভব। কারণ টনির মা-বাবা দুজনে বাগানে কাজ করে চালাতেন পরিবার। আর্থিকভাবে অসচ্ছলতা থাকলেও আদিবাসী এক শিক্ষকের কাছে ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েন টনি। এরপর কক্সবাজারের চকোরিয়ায় এক মামার বাসায় কাজের বিনিময়ে পড়াশোনার সুযোগ পেলে তা হাতছাড়া করেননি আর। এসএসসিতে ভালো ফলাফল করে পড়ার সুযোগ করে নেন দেশসেরা নটর ডেম কলেজে।

পড়াশোনার সংগ্রামের গল্প বলতে গিয়ে টনি বলেন, ‘‌আমরা রোমান ক্যাথলিক। বান্দরবানে সক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য একটি কোর্স করেছিলাম। সেখানে সাতদিনের মতো কাজ করেছিলাম। এরপর ফাদারদের মাধ্যমে নটর ডেম কলেজে এসে সায়েন্সে পড়েছি। এখানে কলেজে যারা নিজেদের টাকায় পড়ে, তাদের ৩-৪ লাখ খরচ করতে হয়। আমরা সেখানে ১২০ জনের মতো ছিলাম, কলেজের মার্টিন ভবনে। সেখানে থাকতে হলে কোনো পয়সা দিতে হয় না। তবে ওখানকার সবাই ভবনের কাজগুলো ভাগ করে নিজেরা করত। কেউ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করত, অফিসে সাহায্য।’ টনি আরো বলেন, ‘‌আমাদের এলাকার জমিজমা কম, মানুষজন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ছিল না। আমার বয়সী অনেকে মাঝপথে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে। আমাদের মিশনারি কলেজে পড়াশোনা করতে টাকা না লাগলেও, যাওয়া-আসা এবং আনুষঙ্গিক অনেক খরচ ছিল, এসবের অভাবেও অনেকে পড়াশোনা করতে পারেনি। আমাদের এলাকায় সাইড ইনকামের সুযোগ খুব কম। আমাকে পড়াশোনা করানোর জন্য আমার বাবা বিভিন্ন বাগানে বাগানে কাজ করত এবং আমার মা সারা বছর জমিতে কাজ করত।’ নটর ডেমে আসার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি একসময় জীবনের অনিশ্চয়তার ঘোরে পড়া টনি ত্রিপুরাকে। এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করে পড়ার সুযোগ পান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। টনি এখন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডার হতে চান।

টনি বলেন, ‘‌প্রত্যেকের জীবনের একটা গল্প থাকে। আমার জীবনেও সে রকম একটা গল্প আছে। সে গল্প কষ্টকর হলেও আমি মনে করে করতে চাই না। আমি চাই সামনের দিকে অগ্রসর হতে। বিসিএস ক্যাডার হয়ে একদিকে দেশের সেবা করতে চাই, অন্যদিকে বদলে দিতে চাই নিজের সম্প্রদায়কে। না হলে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থায় কাজ করার চেষ্টা করব, যেখান থেকে নিজ সমাজের জন্য কাজ করা যাবে।’

টনির কাছে নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে প্রথম প্রতিবন্ধকতা হলো ভাষা। তার ভাষায়, ‘আদিবাসীদের মধ্যে বাংলা ভাষা ভালোভাবে আয়ত্ত করার সুযোগ না থাকায় তারা পড়াশোনায় পিছিয়ে। গ্রামে একটা কমিউনিটি স্কুল আছে কিন্তু সেটাও সরকারীকরণ হয়নি। সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে হয়তো আমাদের মধ্যে আরো অনেক প্রতিভা বেরিয়ে আসত।’ জাবির শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘‌ইন্ডিজেনাস স্টুডেন্টস ফোরাম’র সভাপতি ডেভিড বম বলেন, ‘‌আমাদের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবার প্রতিবন্ধকতা থাকলেও টনির গল্পটা একটু অন্য রকম। টনি এখনো প্রচণ্ড পরিশ্রমী ও পড়ুয়া ছেলে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন