গরমে রেলপথ বেঁকে যাওয়ার শঙ্কা

ঝুঁকি এড়াতে গতি অর্ধেক কমিয়ে চলছে ট্রেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

তাপমাত্রা সহিষ্ণুতার নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে রেলপথ বেঁকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয় ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলে। গতকাল থেকে এ রেলপথের ফৌজদারহাট-সীতাকুণ্ড অংশে ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ৪০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। গরমে রেলের পাত বেঁকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতেই নেয়া হয়েছে এমন ব্যবস্থা। নির্ধারিত এ গতিসীমা বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কার্যকর রাখা হচ্ছে। মূলত এ সময়টায়ই রেলপথ বেশি গরম হয়। 

সাধারণত যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে কম-বেশি ৫ ঘণ্টা সময় নেয়। ফৌজদারহাট-সীতাকুণ্ড অংশে গতিসামা কমিয়ে দেয়ায় এখন অতিরিক্ত ৪০ মিনিট সময় লাগছে বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে। রেলপথ বেঁকে যাওয়ার ঝুঁকি এড়াতে ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রেলপথেও ট্রেনের গতি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। রেলপথটির ভৈরববাজার থেকে নরসিংদীর জিনারদী পর্যন্ত অংশে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করছে। যাত্রীবাহী ট্রেনে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ যেতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতিসীমা কমিয়ে দেয়ায় এখন অতিরিক্ত ১৫ মিনিট সময় লাগছে। একইভাবে গতি কমিয়ে চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে টঙ্গী-জয়দেবপুর, টঙ্গী-নরসিংদী রেলপথেও।

দেশে চলমান তাপপ্রবাহের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে রেলপথের অবস্থান ও মেয়াদ বিবেচনায় নিয়ে ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সংস্থাটির ভাষায় এটাকে স্ট্যান্ডিং অর্ডার বা স্থায়ী আদেশ বলা হয়। সাধারণত গরমের সময় এ ধরনের নির্দেশনা দেয় রেল কর্তৃপক্ষ, যা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কার্যকর থাকে।

রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়ে রেলপাতের তাপমাত্রা ১০-১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকে। ফলে রেলপাতের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে সেটি বেঁকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। ঝুঁকি এড়াতে এ সময় চলাচলরত ট্রেনগুলোকে গতি কমিয়ে চলার নির্দেশনা দেয়া হয়। তাপমাত্রা কমে এলে পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালিক (অতিরিক্ত দায়িত্বে) সরদার সাহাদাত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে চলমান তাপপ্রবাহ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সতর্কতামূলক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গতি কমিয়ে ট্রেন চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-কিশোরগঞ্জের মধ্যে ট্রেন চলাচলের সময় কিছুটা বেড়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আরোপিত সর্বোচ্চ গতিসীমা তুলে নেয়া হবে।’

এদিকে চুয়াডাঙ্গায় গতকাল সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোর, মোংলা, রাজশাহী, ঈশ্বরদী ও কুমারখালী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার থেকেও। দেশে বিরাজমান এ তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈজ্ঞানিকভাবেই রেলপাতের তাপমাত্রা সহিঞ্চুতার একটা সীমা আছে। তা অতিক্রম করলে রেলপথ বেঁকে যেতে পারে। শুধু বাংলাদেশ না, প্রতিবেশী ভারত এমনকি ইউরোপের অনেক দেশেও গ্রীষ্মের সময় এ ধরনের সমস্যা হয়। ঝুঁকি এড়াতে ট্রেনের গতি কমিয়ে দেয়া বা ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা ওইসব দেশেও হয়। 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গরমে রেলের পাত বেঁকে যাওয়ার ঝুঁকি এড়াতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রেলপথ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা। আমাদের তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে যেসব পথ নতুন তৈরি হয়েছে, সেগুলোয় গরমের কারণে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু পুরনো রেলপথগুলো ঝুঁকির মধ্যে আছে। সেগুলোর “হেলথ মনিটরিং” খুবই গুরুত্বপূর্ণ। “‍হিট সেন্সর” নামে একধরনের ডিভাইস পাওয়া যায়। চৌম্বকীয় এ ডিভাইস রেলপাতের সঙ্গে আটকে দেয়া যায়, যা ব্যবহার করে পাতের তাপমাত্রা সহজেই জানা সম্ভব। তাপ সহিষ্ণু মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে ট্রেনের গতি কমিয়ে দেয়া বা ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও হয়।’

ঝুঁকি এড়াতে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে ট্রেনের গতি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে রেলওয়ের আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিত মন্তব্য করে ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণে সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ের অনেক দুর্বলতা আছে। সংস্থাটির উচিত ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথগুলোয় এখনই সাদা রঙ করে দেয়া। এ রঙ রেলপাতকে তাপ সহনীয় করে তোলে। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে রেলপাতের তাপমাত্রা ৫-৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথগুলোর দুই পাশে পর্যাপ্ত পাথর নিশ্চিত করতে হবে। স্লিপারগুলো ভালো অবস্থায় রাখতে হবে। রেলপাতের জয়েন্টগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এর বাইরে সময়ে সময়ে “‌ডিস্ট্রেসিং” (দুই পাতের মাঝে নির্দিষ্ট দূরত্ব রাখা) করতে হবে। এসব পদ্ধতি ব্যবহার করে গরমের সময় রেলপথ ঝুঁকিমুক্ত রাখা সম্ভব।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন