আলোকপাত

বাংলাদেশের স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর: অর্জন ও অন্তরায়

সেলিম জাহান

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী গেল বছর তিনেক আগে। এ বছরের ২৬ মার্চ ৫৩ বছর পূর্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার। ১৯৭১ সালে নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের। সে স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে, তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতিপলে, প্রতিপ্রাণে।

আজ ২০২৪ সালে এসে যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন দেখি অর্জন আমাদের অনেক, বিশেষত আর্থসামাজিক অঙ্গনে। ৫২ বছর আগে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ, তারপর সে আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। গত ৫৩ বছরে দেশটির অনন্য সাফল্যের কারণে বিশ্ব তাকে চিহ্নিত করেছে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলে। 

গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ; ৩৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৫০ বিলিয়ন। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩০০ ডলার থেকে ২ হাজার ৬৪ ডলারে। মধ্য-নব্বইয়ের দশকে যেখানে দেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমায় ছিল, আজ সেখানে মাত্র ২১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমায় বাস করে। বয়স্ক সাক্ষরতার হার ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল ৩৫ শতাংশ, আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্তির হার ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ ৭৫ শতাংশ থেকে ৯৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাদ্বয় হচ্ছে যথাক্রমে ২০ ও ৬৬ শতাংশ। ওই সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২১-এ নেমে এসেছে এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি ১ লাখে ৫৯৪ থেকে ১৬৫-তে হ্রাস পেয়েছে। আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ অগ্রগতি বিস্ময়কর।

আসলে সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু আজ যেখানে ৭৩ বছর, ভারতে যেখানে ৭০ বছর, পাকিস্তানে যেখানে ৬৭ বছর। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশ প্রতি হাজারে ৩১, ভারতে ৩৫ ও পাকিস্তানে ৬৭ বছর।

মানবজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসিত হয়েছে। জানি, অন্তরায় অনেক আছে, কিন্তু তবু দেশের ভেতরে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বারবার উন্নয়ন আলোচনায় উঠে এসেছে। উদ্যোক্তা হিসেবে বহু খাতে নারীরা অগ্রণী হিসেবে কাজ করছেন। সামান্য মুঠোফোনের ওপর ভরসা করে তারা তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছেন। পোশাক শিল্পে মূলত তাদের অবদান থেকেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগের উৎপত্তি। প্রশাসনের নানা স্তর এবং পর্যায়েও তাদের সরব উপস্থিতি। সামাজিক অঙ্গনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। বহু ক্ষেত্রে তাদের অবদান পুরুষের অবদানকে ছাড়িয়ে গেছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রেই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

বাংলাদেশের তরুণ সমাজের কর্মকুশলতা, সৃজনশীলতা এবং সৃষ্টিশীলতা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদেরকে আশাবাদী করেছে। প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে তারা যেসব নতুন নতুন পদ্ধতি বা জ্ঞান সম্প্রসারণবিষয়ক কাজ করছেন তা দৃষ্টান্তমূলক। নানা ক্ষেত্রে নব্য জ্ঞান ও উদাহরণমূলক কাজের মাধ্যমে আমাদের তরুণ সমাজ দেশ ও সমাজের জন্য এক বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। এ অর্জন উদযাপিত হওয়া প্রয়োজন।

দেশের ভেতরে নাগরিক সমাজের বিস্তার ও বেসরকারি সংস্থার বিস্তৃতি আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে মজবুত করেছে এবং বহু ক্ষেত্রে সরকারের সীমাবদ্ধতার বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা বিষয়ে তারা জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এ রকম একটি জ্বলজ্বলে উদাহরণ। সাধারণ মানুষের কাছে নানা রকমের সেবা পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে বেসরকারি সাহায্য সংস্থার ভূমিকা লক্ষণীয়। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে, নানা স্বাস্থ্যসুবিধা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেয়া, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুপেয় জলের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তাদের নানা কার্যক্রম অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে।

বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের তিনটি অর্জনের জন্য আমি গর্ববোধ করি। এক. জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশীদের ভূমিকা। বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাত কেন্দ্রে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী কর্মকর্তারা যে নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন, তা সবার কাছে নন্দিত হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, তাদের পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়েও তারা স্থানীয় জনগণের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছেন।

দক্ষিণ সুদানের বুভুক্ষ জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনী খাবার ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। হাইতিতে কলেরার প্রকোপ এড়ানোর জন্য আমাদের সেনারা বহুদূর থেকে শুদ্ধ জল বহন করে এনেছেন সাধারণ মানুষের জন্য। নানা দেশ নানাভাবে এ অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে। সিয়েরা লিওন বাংলাকে তার দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশে আমাদের সেনারা চরম আত্মত্যাগও স্বীকার করেছেন। চিরনিদ্রায় তারা শায়িত আছেন নানা ভূমিতে। স্থানীয় জনগণ পরম যত্নে, পরম মমতায় এ বীরদের শেষ শয্যা তৈরি করে দিয়েছে।

দুই. মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমিকরা শুধু কাজকর্ম করেন না, শুধু দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন না, তারা বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদূতও বটে। এসব মানুষ তাদের কঠোর পরিশ্রম, কর্মকুশলতা ও সততার মাধ্যমে তাদের দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। ব্যাপারটি মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও ঘটতে দেখেছি। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিপণিতে বাঙালি কর্মীদের চাহিদা অনেক বেশি, তাদের নিষ্ঠা, দক্ষতা ও সততার কারণে। এ বিষয়গুলো শুধু ব্যক্তিগত পেশাগত কর্মের উৎকর্ষকে তুলে ধরে না, এসব মাত্রিকতা দেশকেও তুলে ধরে। এ অর্জনের তুল্য কি কিছু আছে? 

তিন. কূটনৈতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশ নানা প্রয়াসে ও গোষ্ঠীতে নেতৃত্ব দিয়েছে অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে। পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক আন্দোলন ও নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রয়াসে বাংলাদেশ নানা সময়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতিসম্প্রতি কভিডের টিকা আবিষ্কারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা দলকেও অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ। 

কিন্তু এত সব অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি আর্থসামাজিক অন্তরায় আমাকে ভাবিত করে। প্রথমত, সমাজের ক্রমবর্ধমান অসমতা—ফলাফলের ক্ষেত্রে এবং সেই সঙ্গে সুযোগের ক্ষেত্রেও। আয়ের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার উচ্চতম ১০ শতাংশ যেখানে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ ভোগ করেছে, সেখানে জনসংখ্যার নিম্নতম ৪০ শতাংশ দেশজ আয়ের ১৩ শতাংশ পেয়েছে। বরিশালে বয়স্ক সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সেখানে সিলেটে সে হার হচ্ছে ৬০ শতাংশ। শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১ শতাংশ, সেখানে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ।

অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসমতা লক্ষণীয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব নিতান্তই প্রান্তিক। বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য লক্ষণীয়—দরিদ্র মানুষ সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্হান করছে। ঢাকা শহরেই বিত্তবান এলাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে অন্য এলাকার জীবনযাত্রার মানের কোনো মিল নেই। ধনী-দরিদ্রের সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কথাও সর্বজনবিদিত।

দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে মানুষের ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতা আমাকে ভাবিত করে। আমরা আমাদের ভাবনাতেই মগ্ন—আমার নাম, আমার অর্থবিত্ত, আত্মপ্রচার। আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের সব অর্জন কিন্তু যূথবদ্ধতার ফসল। আমরা যৌথভাবে আন্দোলন করেছি, সবাই মিলে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সমাজের মূল শক্তিই ছিল যূথবদ্ধতা। কিন্তু আজ আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের প্রত্যেকের অগ্রগতি ও নিরাপত্তা আমাদের একার ওপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে যে বৃহত্তর কাঠামোর আমরা অংশ, তার ওপর। মনে রাখা দরকার যে, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও তা থেকে রক্ষা পায় না। 

আমাদের আর্থিক সাফল্যকেই আমরা একজন সফল মানুষের নির্ণায়ক বলে মেনে নিয়েছি। বিত্তের মাপকাঠিতেই আজ আমরা মানুষের মূল্যায়ন করছি। শিক্ষা, মানবিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, ভদ্রতা-শোভনতা এগুলোকে আমরা আর মনুষ্য বিচারের মাপকাঠি বলে ভাবি না। ফলে মানুষের বহু সুকুমার বৃত্তিকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি—তাদের অপ্রাসঙ্গিক ও মূল্যহীন করে ফেলেছি।

তৃতীয়ত, সমাজে সন্ত্রাস ও সহিংসতার ব্যাপ্ত বিস্তৃতি ঘটেছে। আমাদের সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতেও আমরা ভুলে যাই। যেকোনো মতভেদ, মতানৈক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমরা আজ কথাবার্তার পরিবর্তে শক্তিকেই ব্যবহার করি—পেশিশক্তি, বিত্তশক্তি, ক্ষমতার শক্তি। তার পথ ধরেই এসেছে অস্ত্রায়ণ, সহিংসতা আর সন্ত্রাস। যেকোনো মতবিরোধ, মতানৈক্য আর মতভেদে আমরা আশ্রয় নেই সহিংসতা আর সন্ত্রাসের। সহিংসতা আজ আমাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সন্ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সংস্কৃতি।

চতুর্থত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর জনগণের সার্বিক মুক্তির চালচিত্র মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সব ধরনের সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।

আজ বাংলাদেশ এ মূলনীতিগুলো থেকে সরে এসেছে। ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশী’ এ ধরনের ধুয়ো তুলে আমাদের বাঙালিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মকেন্দ্রিক মৌলবাদী অপশক্তিকে আসকারা দিয়ে উদারপন্থী বাঙালিত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ শঙ্কাক্রান্ত। আমরা ভুলে গেছি যে, গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর সংগ্রামের নামই গণতন্ত্র। সামাজিক ন্যায্যতা আজ মুখে মুখেই আমরা বলি, আমাদের কাজে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। সুতরাং, আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে, অসমতা আছে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। আমাদের চিন্তায়, কাজে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। 

পঞ্চমত, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আবার জেঁকে বসেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে। এদেরই পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যার দোসর হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ইতিহাস বিকৃত করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ এবং যেকোনো মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এ অপশক্তি এক বিরাট হুমকি। এ এক অশনিসংকেত এবং এ আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রাম।

এসব কাঠামোগত অন্তরায় আর প্রতিবন্ধকতাগুলোকে জয় করতে হলে সবাই মিলে এগুলোর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, সব সমাধান আমাদের একার হাতে নেই এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা এসবের সমাধানও করতে পারব না। কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় আমরা এখনই চিন্তাভাবনা করতে পারি। যেমন আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠার মূল ভূমিকা নিতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রের। অপশক্তি নির্মূলেও অগ্রগণ্য ভূমিকা রাষ্ট্রের। 

অসমতা দূরীকরণে অন্তর্ভূত প্রবৃদ্ধি নীতিমালা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, করনীতিতে সংস্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে এবং সহিংসতা ও সন্ত্রাস বন্ধে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি ভূমিকা আছে সামাজিক আন্দোলনের। সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগতভাবে বহু কিছু করার আছে। মনে রাখা দরকার যে, ‘এ দায়ভাগে আমরা সমান অংশীদার, অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, আমাদের পরে দেনা শুধবার ভার’।

আমাদের যাত্রাপথে আমরা একটি ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছি। পার করেছি স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী, সামনে পড়ে আছে এক দীর্ঘ পথযাত্রা। এ ক্রান্তিলগ্নে এসে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাগুলো, যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭২ সালে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশমুখী পথযাত্রায় তিনি বলেছিলেন—‘আমার এ পথযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর পথে, বন্ধিত্ব থেকে মুক্তির পথে, একাকিত্ব থেকে আশার পথে’। সেই সুরে আমি বলি, ‘আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের পথযাত্রা হতে হবে বঞ্চনা থেকে প্রাচুর্যের পথে, প্রতিবন্ধকতা থেকে সুযোগের পথে এবং দিকদর্শন থেকে কর্মকাণ্ডের পথে। 

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন