অভিমত

কিউলেক্স ও এডিসের চোখরাঙানিতে বিপর্যস্ত নগর জীবন

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

ছবি : বণিক বার্তা

ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের ব্যঙ্গ কবিতার লাইন ‘রাতে মশা দিনে মাছি এই নিয়ে কলকাতায় আছি’ এখন ছান্দিক পরির্বতন হয়ে হয়েছে ‘রাতে কিউলেক্স, দিনে এডিস, এই হলো নগরাবেশ।’ গত ২২ বছরের সব রেকর্ড ভেঙে এডিসের ভয়াল আক্রমণে ডেঙ্গুতে ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ মাত্রায় আক্রান্ত হয়েছে মানুষ; রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ৭০৫ ও হার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, যা জানান দিয়েছিল এডিসের তাণ্ডবশীলা। ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৯৬ ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৯। ২০২৪ সালের ১৬ মার্চে এসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩৭ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২০। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় ২০২৩-এর তুলনায় ২০২৪ সালে তা দ্বিগুণ বেড়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, এখন ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কতটা শিহরণ জাগাচ্ছে। এ ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধে এ পর্যন্ত গৃহীত পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতা মূল্যায়ন ও তদারকি কত বেশি প্রয়োজন তা অতি সহজেই অনুমেয়। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন স্থল চিহ্নিত করা ও এর ধ্বংস নিশ্চিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োগকৃত লার্ভিসাইড ও অ্যাডালটিসাইডের কার্যকারিতা, প্রয়োগ পদ্ধতি, ব্যবহৃত মেশিনের কর্মদক্ষতা, প্রয়োগকারীর প্রাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রায়োগিক দক্ষতা সর্বোপরি এডিস মশার প্রতিরোধী হয়ে উঠার তীব্রতা—এ সবকিছুই যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আর বিশেষজ্ঞদের তদারকিতে না হয়, তাহলে সময় যত গড়াবে ভয়াবহতা আর চোখ রাঙানি ততই বাড়বে। 

আমরা বাদশাহ নমরুদের ইতিহাস সবাই জানি। একটি পা-বিহীন ল্যাংড়া মশা বিশাল প্রতাপশালী এক বাদশাহকে ধরাশায়ী করেছিল। তার শেষ পরিণতি মৃত্যুতে শেষ করে অতি স্বাচ্ছন্দ্যে মশা উড়ে গিয়েছিল। ওই মশা কোন প্রজাতির ছিল তা ওতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, কারণ মশাটি এখানে কোনো অণুজীবের বাহক হিসেবে কাজ করেনি। কাজ করেছে অস্বস্তি আর বিরক্তিকর এক কীট হিসেবে। মশাটি যদি কোনো বাহক হিসেবে কাজ করত পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতো। সন্ধ্যা হতে সারা রাত যে পতঙ্গটি চরম বিরক্তি আর রক্তশোষণ করে আমাদের নাজেহাল করেই চলেছে, সেই পতঙ্গটির নামই হলো কিউলেক্স প্রজাতির মশা। এ মশা যে শুধু গুনগুন করে আরামের নিদ্রাভঙ্গ করে তা-ই নয়, বরং ফাইলেরিয়া, ইনক্যাপালাইটিস (জাপানিজ ও সেন্টলুইস) ওয়েস্টনিল ভাইরাস প্রভৃতির মতো মারাত্মক রোগ ছড়ায়। এ প্রজাতির মশাই আমাদের দেশে অত্যধিক। কৃষক ও খামারিরা গরুকে এ মশার হাত থেকে রক্ষার জন্য মশারি ও ক্ষেত্রবিশেষে সালার চট ব্যবহার করে থাকেন। কারণ গো-মূত্র যে স্থানে জমা হয় সেই স্থানটি এ মশার উর্বর প্রজনন স্থল। একইভাবে দূষিত পানি, জমে থাকা পানি, ডোবা নালা, শহরের পরিত্যক্ত ম্যানহোল অপরিচ্ছন্ন স্থানে জমা পানিই এ মশার প্রজনন উৎস। এ মশা এডিস মশার মতো কোনো শীত-গ্রীষ্ম তোয়াক্কা করে না। সারা বছরই নিজ গুণে প্রজনন চালিয়ে যায়। ঢাকা শহরের যেসব অপরিচ্ছন্ন লেক, নালা ও জমানো পানি রয়েছে সেই স্থানগুলোয় সন্ধ্যার সময় এ মশার বিশাল বিশাল দল যেকোনো মানুষের চারদিকে কম্বো স্টাইলে আক্রমণ করে ভয়ংকরভাবে রক্ত শোষণ করে এবং রোগজীবাণু শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয় এবং চরম বিরক্তি সৃষ্টি করে। এর ফলে অসহ্য হয়ে পড়েছে নগরজীবন। বিশেষ করে ঢাকা শহর যে এলাকাগুলোয় বিস্তৃতি লাভ করছে সেই এলাকায় তাদের দাপট চরমে পৌঁছেছে। নগরজীবনের অনেক সমস্যার মধ্যে এ মশার সমস্যাটি অন্যতম। এখন প্রশ্ন হলো, এ ভয়ংকর সমস্যা সৃষ্টিকারী কিউলেক্স ও এডিস মশার করালগ্রাস হতে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী? এডিস মশার ভয়াবহতা সংখ্যাধিক্য কিউলেক্সের তুলনায় অনেক ভয়ংকর। এ এডিস মশার ধ্বংস তৎপরতায় নগরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা গলদ্ঘর্ম হয়ে চলেছেন। কিন্তু বিশাল শত্রু বাহিনী কিউলেক্স মোকাবেলায় নেই তেমন কোনো সুব্যবস্থা। মশাবাহিত রোগকে বলা হয় নেগলেকটেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ। অর্থাৎ এ রোগগুলো সুবিধাবঞ্চিত মানুষের রোগ, বিশেষ করে মানসম্মত বাসস্থানে যাদের বসবাস করার সামর্থ্য নেই তাদের রোগ হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশে যাদের মানসম্মত বাসস্থানে বসবাসের কথা বা বিলাসবহুল অট্টালিকায় যাদের বসবাস, নগরের সর্বোচ্চ শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাসস্থানের পাশেই সাংঘাতিক বিরক্তিকর ও ক্ষতিকর মশার আবাসস্থল রয়েছে। ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরা প্রভৃতি আবাসিক অঞ্চলে প্রচুর কিউলেক্স মশার উৎপাত রয়েছে। এ কিউলেক্সের হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য সর্বপ্রথম যে ব্যবস্থা প্রয়োজন তা হলো অপরিচ্ছন্ন জলাশয় পরিপূর্ণ সংস্কারের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নিশ্চিতকরণ এবং নাগরিক সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা নিশ্চিতকরণ। এ কাজে জনগণ শুধু সচেতন হলেই হবে না, তাদের সম্পৃক্ত থাকতে হবে। একবার পরিষ্কার করলেই চলবে না; তা নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কীটনাশক সহনীয় মাত্রায় প্রয়োগের মাধ্যমে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে। লেক ও বিনোদন পার্কের মধ্যে নাগরিক সচেতনতা আরো বেশি প্রয়োজন। কারণ এ স্থানগুলোয় বিভিন্ন ধরনের ক্যান ও প্লাস্টিক পরিত্যক্ত অবস্থায় এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধি করেই চলছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধির পূর্ণ সম্পৃক্ততার মাধ্যমেই এ মশকীদের অত্যাচার ও অস্বস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এভাবেই বসবাসের নিরাপদ স্থান হিসেবে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশ।

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন