পা ঠ প্র তি ক্রি য়া

খালেদের লেখা খসরুকে নিয়ে স্মৃতি

দাউদ হায়দার

ছবি: আইএমডিবি

শিল্পবিষয়ক তো বটেই, আরো বহুবিধ লেখায় মইনুদ্দীন খালেদ অতীব মুন্সি। মেদহীন গদ্য। সুপাঠ্য। বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনায় সাবলীল। উসকে দেন চিন্তার জট। জোগানদাতা নানা সূত্র। সহজ ও সরলতার সঙ্গে দীপ্তির বিচ্ছুরণ। পাঠক হিসেবে নিজেকে ধন্য মানি।

খালেদের সাম্প্রতিক লেখা বণিক বার্তায় (২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪), লিখেছেন মুহম্মদ খসরুকে নিয়ে। বাংলাদেশের সুস্থ চলচ্চিত্র আন্দোলনের পয়লা প্রফেট। বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটির খাঁটি বীর, যোদ্ধা। অক্লান্ত। ওর গুণপনায় বিএফএস (বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি) কচি শেকড় থেকে মহীরুহ। ছায়াতলে আরো বৃক্ষ। ক্রমপ্রকাশিত।

খসরুর মুখনিসৃত ‘বাণী’ অমৃত সুধা নয়, অনেকের কাছে গরল, কিন্তু একবার হজম করলে সুপেয়।

প্রথম পরিচয়ে: ‘ওই মিয়া...ছাল পদ্য লেখো, ছাইড়াটাইড়া আমার লগে আসো।’

মেজাজ বিগড়ে গেল। ‘আবার যদি বলেন...’

‘ছিঁড়বা নাকি? হিম্মত আছে? যাও, বাড়িত গিয়া গুড়মুড়ি লইয়া আসো। সারা দিন খাই নাই।’

অবাক হলুম, সকাল থেকে না খেয়ে?

গত শতকের ১৯৬৭ সালের কথা লিখছি। খসরুর হুবহু ডায়ালগ, হয়তো নয়। কানে যেটুকু সেঁধে আছে। কান বিট্রেও করতে পারে। তবে খসরুর বাগধারা খুব ভিন্ন ছিল না।

খসরু ছিলেন প্রতিবেশী। ১৩ ঘর পরে। একটু গলিতে। আমরা ১৪/২ মালিবাগে। তথা ‘একটু’ সদরে। রাস্তার পাশেই। আবুজর গিফারী কলেজ থেকে ২ মিনিট হাঁটা পথ দূরে। ২০ কদম এগিয়ে, ছোট্ট গলিতে কবি হুমায়ুন কবিরের আস্তানা। গুলবাগের প্রবেশমুখে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একজন ডালিমের বাড়ি। ওর দুই বোনকে ভালোই চিনতাম। ডালিমের মামা বা ওই রকম কিছু শিল্পী আমিনুল ইসলাম। ডালিমের বাড়িসংলগ্ন। তার পাশের বাড়ি অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের। তার ছোট ছেলে আবু সাঈদ জুবেরী। লেখক। জাহিদ হায়দারের কৈশোরিক বন্ধু। 

সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে পড়ি। ম্যাট্রিক পরীক্ষার মাস কয়েক বাকি। খসরুর সঙ্গে সকাল-বিকাল দেখা। একদিন খসরু: ‘...খুব গজাইছে? চলো।’

যাই।

(সপ্তাহে তিন-চারদিন যাই) 

খসরুর ঘরের চেহারা কী রকম? সাকল্যে কুড়ি ফুট। এক কোণে চুলো। চেয়ার টেবিল নেই ঘরে। দুটো তক্তা দিয়ে চৌকি। পায়া নেই। চৌকি প্রায় তিন ফুট। বইপত্র দিয়ে চৌকি উঁচু। চৌকিতে ময়লা বিছানা। জামাকাপড় ইতস্তত। মেঝেতে বিস্তর বই। সব বই সিনেমাসংক্রান্ত। কিছু প্রবন্ধ, উপন্যাস। ‘ওই মিয়া, বই ধরবা না। বই আমার ডার্লিং।’

১৯৬৮ সালের এপ্রিলে কালবৈশাখী। একনাগাড়ে দুদিন বৃষ্টি। মা বললেন, খসরুকে খাবার দিয়ে আয়।

গিয়ে দেখি খসরু চৌকির ওপর বসে। চোখে জল। বৃষ্টিতে সব বই ভিজে গেছে। কয়েকটি ভাসমান। 

রসিকতা: ‘বই আসলে বৃষ্টির বউ, জড়াজড়ি করে থাকে।’

যত দিন যায় খসরুর মোহে সম্মোহিত। ওর খিস্তি হজম। 

‘বুঝলা মিয়া, এইসব বাংলার মানুষের আপন ডায়ালগ। শালা শব্দ দুই রকম, দুই অর্থে। কেউ যদি কয়, আরে শালা কেমন আছিস, ওটা আত্মিক। শালাকে দেখে নেব, তার মানে ঝামেলা। চোখ রাঙিয়ে শালা কওয়া আরো বিপদ।’ 

খসরুর পাল্লায় পড়ে ফিল্ম সোসাইটি নিয়ে চরম মাতামাতি। শহরের নানা জায়গায় হাতে লিখে পোস্টার সাঁটা: ‘ভালো ছবি দেখুন। যোগ দিন ফিল্ম সোসাইটিসের আন্দোলনে।’ 

পোস্টার সাঁটাচ্ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, চারুকলা বিদ্যালয়ে, পাবলিক দেয়ালে। 

একজন সুন্দরী গাড়ি থেকে নেমে খসরুকে কী বললেন। 

সুন্দরী চলে গেলে: ‘উনি কে জানো? উনি অভিনেত্রী রেশমা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে শো, গোটা পঞ্চাশ দর্শক। টিকিট ছাড়া। শো শেষে: ‘আরো করতে হবে।’

ভালো ছবি, ছবির প্রজেকশন ইত্যাদির খরচ। টাকা কোথায়? ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে পথে নামলাম। ১০৩ টাকা জোগাড়। পরবর্তী শো ‘সেভেন সামুরাই।’

সোসাইটি চালানো, ছবির প্রদর্শনী চাট্টিখানি বাতেলা নয়। এগিয়ে এলেন মাহবুব জামিল। নাজ সিনেমা হলের বিপরীতে তার অফিস। সিঙ্গারের। তখন কর্মী তিনি। যুক্ত হলেন আন্দোলনে। বহুজনকে ফোন করে অর্থ সাহায্যপ্রার্থী। 

আন্দোলনের সুবাদে মাহবুব জামিলের অফিসে খসরুর সঙ্গে প্রায়ই হাজির। জামিল লাঞ্চ করান। 

একটি পদ্য লেখার অপরাধে কয়েক মাস জেলে ছিলাম। খসরু বার পাঁচেক দেখা করতে আসেন। জানান, ‘তুমি ছাড়া বিএফএস আরো জমজমাট। বহু হারামি পাবলিক যোগ দিয়েছে।’

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতায় গিয়ে খসরুর চিঠি পেলাম। 

‘ধ্রুপদীর (পত্রিকা) জন্য সত্যজিতের একটি লেখা জোগাড় করতে পারবে?’ পারিনি। ধ্রুপদী পাঠিয়েছিলেন। সত্যজিৎকে দিয়েছিলুম। প্রশংসায় অতিকথা। 

বন্ধু খসরুকে নিয়ে নানা স্মৃতি। অল্পকথায়, গল্প শেষ নয়। স্মৃতি উসকে দিয়েছেন খালেদ। শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের কলাকেন্দ্রে ‘খসরু প্রদর্শনী’ নিশ্চয় একটি যুগের, একজন মানুষের, ইতিহাস অতীত ও বর্তমান একাত্ম। খসরু সর্বদা স্মরণীয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন