জোকো উইডোডো : খুপরি ঘর থেকে ইন্দোনেশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা

বণিক বার্তা অনলাইন

ছবি : রয়টার্স

রাজনৈতিক ও সামরিক অভিজাতদের বাইরে থেকে আসা ইন্দোনেশিয়ার প্রথম নেতা জোকো উইডোডো। মূলত ইন্দোনেশিয়ার মানুষের এক সময় গণতন্ত্রের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু উইদোদোর জয়ের পর সেই হতাশা বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়েছে। এ কারণেই যখন তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট হন তখন  টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রের নতুন মুখ’ বলে অভিহিত করেছিল।

উইডোডো ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই দেশটির জিডিপি ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে ইন্দেনেশিয়ায় অবকাঠামোগত উন্নয়নও বৃদ্ধি পায় উল্লেখযোগ্য হারে।

তাই আসন্ন অবসর সত্ত্বেও তিনি ৭০ শতাংশের বেশি অনুমোদন রেটিং নিয়ে এখনো তুমুল জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী কিংমেকারে পরিণত হয়েছেন জোকো ইউডোডো।

জোকো উইডোডো ১৯৬১ সালে সোলো শহরে কাঠ বিক্রেতা বাবার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় সরকার কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়ার আগ পর্যন্ত ইউডোডো এবং তার পরিবার সেই শহরের নদী তীরের একটি খুপরিতে বসবাস করতেন।

জোকো ইউডোডো রাজনীতিতে আসেন ২০০৫ সালে পার্টি অফ স্ট্রাগল নামক রাজনৈতিক দলে যোগদানের মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি তিনি মধ্য জাভার সোলো শহরের মেয়র নির্বাচিত হন।

২০১২ সালে তিনি একটি দুর্দান্ত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার গভর্নর নির্বাচিত হন।দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে উইডোডো একজন তৃণমূল নেতা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন ।

গভর্নর নির্বাচিত হওয়ার মাত্র দুই বছরের মাথায় উইডোডো বিপুল ভোটে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

বিশ্লেষকদের মতে, ইন্দোনেশিয়ার রাজবংশীয় রাজনীতি ও দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠা জনগণ জোকো উইডোডোকে দেখেছিল একজন বিপ্লবী হিসেবে।

ইন্দোনেশিয়ার ন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন এজেন্সির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিরমান নূর বলেন, তিনি একজন সাধারণ ইন্দোনেশিয়ান রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে ২০১৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় একটি স্লোগান প্রচলিত ছিল- 'জোকো আমাদেরই  একজন'।

তবে উইডোডো প্রশাসনের সূচনা ছিল কিছুটা নড়বড়ে। সেটি সামলে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অবকাঠামো উন্নয়নে একটি শক্তিশালী ট্র্যাক রেকর্ড তৈরি করেছেন।

ইন্দোনেশিয়ায় ১৬টি নতুন বিমানবন্দর, ১৮টি বন্দর, ৩৬টি বাঁধ এবং ২০০০টি টোল রাস্তা সহ ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে উইডোডোর হাত ধরে। আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়া ২০২৭ সালের মধ্যে রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্যকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তবে উইডোডোর বিপুল জনপ্রিয়তায়ও যে কিছু দাগ নেই , তা নয়। মাদক পাচারকারীদের মৃত্যুদণ্ড শাস্তি পুনর্বহাল করা, বিতর্কিত প্রাক্তন জেনারেল প্রাবোও সুবিয়ান্টোকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া এবং তার বড় ছেলে জিব্রান রাকাবুমিং রাকাকে তার রানিং সঙ্গী হিসেবে নিয়োগের জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। যদিও উইডোডো খোলাখুলিভাবে কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করেননি তবে প্রবোওর প্রচারণা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন। বিশ্লেষকদের মতে এটি  তার এবং তার নিজের দল পিডিআই-পি-এর মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে।

সম্প্রতি সমালোচকরা উইডোডোর বিরুদ্ধে তার রাজনৈতিক রাজবংশ গড়ে তোলার অভিযোগ করেছেন। অথচ উইডোডো নিজেই পূর্বে বলেছিলেন , প্রেসিডেন্ট হওয়া মানে সন্তানদের হাতে ক্ষমতা দেয়া নয়।

উইডোডোর শ্যালকের নেতৃত্বে একটি সাংবিধানিক আদালত ৩৬ বছর বয়সী জিব্রানকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেয়, যদিও প্রাথমিক ইন্দোনেশিয়ান আইনে তার বয়স আরো বেশি হতে হতো।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জিব্রান প্রেসিডেন্ট হলে তার কোনো নিজস্বতা থাকবে না বরং বাবার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই তার উদ্দেশ্য হবে।

তবে কিছুদিন আগে সমালোচকদের মন্তব্যের জবাবে উইডোডো বিবিসিকে  বলেছিলেন, তিনি যদি সরাসরি তার ছেলে বা পরিবারের কোনো সদস্যকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন তবেই সেটা রাজনৈতিক বংশ বলে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু তারা যদি নির্বাচনে অংশ নেয় , তখন আর সেখানে রাজনৈতিক বংশ পরম্পরার হিসাব থাকবে না। কারণ তখন জনগণ গণতান্ত্রিকভাবে তাদের নেতা নির্বাচন করবে।

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট উইডোডো তার বৈদেশিক নীতির অভিজ্ঞতার অভাবের প্রাথমিক সমালোচনা মুখোমুখি হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও দেশটির বিশ্বব্যাপী উপস্থিতির উপর জোর দিয়েছিলেন তিনি।

ইন্দোনেশিয়া ২০২২ সালের নভেম্বরে জি টোয়েন্টি সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে প্রথম বৈঠকের আয়োজন করেছিল।

এশিয়ার নেতাদের মধ্যে উইডোডোই প্রথম রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের কারণে ইন্দোনেশিয়ার খাদ্য সংকট  মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট উইডোডো জি টোয়েন্টির সদস্য দেশগুলিকে আক্রমণের নিন্দা করতে চাপ দিতে সক্ষম হন।উইডোডো মায়ানমারের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আসিয়ানকে (দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতি সংস্থা) ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন।

গত বছরের শেষের দিকে গাজা যুদ্ধের বিষয়ে দেশগুলোর ভিন্ন মত থাকা সত্ত্বেও উইডোডো হোয়াইট হাউসে জো বাইডেনের সঙ্গে দেখা করার পর দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে।

এছাড়া উইডোডোর নেতৃত্বে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে ইন্দেনেশিয়া। বৃহৎ চীনা বিনিয়োগ ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতিকে বহুমুখী করে তুলেছে।

তবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য চীন  ২১.৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ানদের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে চীনা ঋণের ফাঁদে আটকে পড়ার আতঙ্ক।

উইডোডোর প্রশাসন ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক প্রোফাইলকে শক্তিশালী করেছে, কিন্তু তার উত্তরাধিকার ব্যবস্থা ইন্দোনেশিয়ার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে ব্যর্থও হতে পারে।


 


 


 


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন