প্রবেশমুখে অব্যবস্থাপনা ও অপ্রতুল অবকাঠামো

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের সুফল ঢাকার যানজটে বিলীন

শামীম রাহমান

ছবি: মাসফিকুর সোহান

রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক (ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে) ও পদ্মা সেতু। আগে ফরিদপুর থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসতে সময় লেগে যেত কয়েক ঘণ্টা, এখন লাগছে ঘণ্টা খানেকের মতো। তবে এ পথে দ্রুতগতিতে ঢাকায় আসা যানবাহনের চাকা থমকে যেতে হচ্ছে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান এসে। দিনের ব্যস্ততম সময়ে এ প্রবেশমুখ পার হতেই লেগে যাচ্ছে এক-দেড় ঘণ্টা। ফলে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে সুফল এনে দিয়েছে, তা অনেকটাই বিলীন হতে বসেছে অব্যবস্থাপনা ও অপ্রতুল অবকাঠামোর কারণে সৃষ্ট তীব্র যানজটে।

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ঢাকায় প্রবেশের প্রধান দুই প্রবেশপথের একটি যাত্রাবাড়ী। মাওয়ার দিক থেকে এসে ঢাকা-চট্টগ্রাম বা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দিকে যেতে হয় এ পথ দিয়ে। আবার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার ব্যবহার করে গুলিস্তান বা পলাশী কিংবা সায়েদাবাদ হয়ে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে। এসব সুবিধার কারণে স্বভাবতই এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ঢাকার দিকে আসা বেশির ভাগ যানবাহন যাত্রাবাড়ীর প্রবেশপথই ব্যবহার করে।

গাড়ির চাপ বেশি থাকায় দিনের বেশির ভাগ সময় যাত্রাবাড়ীর প্রবেশপথে যানজট লেগে থাকে। গতকাল সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে শুরু হওয়া যানজট গিয়ে ঠেকেছে এক্সপ্রেসওয়ের দোলাইরপাড় বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। আর যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে শুরু হওয়া পুরো গুলিস্তান সড়ক যানজটে পূর্ণ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, যানবাহনের চাপ বেড়ে গেলে যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে শুরু হওয়া যানজট মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের দোলাইরপাড় মোড়ও ছাড়িয়ে যায়। গাড়ির জট সৃষ্টি হয় এক্সপ্রেসওয়ের নিচের সড়কেও। 

গুলিস্তান সড়কের যানজট এড়াতে এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করা বেশির ভাগ যানবাহন টোল দিয়ে হানিফ ফ্লাইওভার ব্যবহার করে। তবে হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নামার প্রতিটি পথেও যানজট দেখা গেছে। কোথাও কোথাও গাড়ি থমকে যেতে দেখা গেছে ৫০০ মিটার থেকে এক কিলোমিটার পর্যন্ত।

যাত্রাবাড়ী পয়েন্ট দিয়ে সম্প্রতি ঢাকায় প্রবেশ করতে গিয়ে হানিফ ফ্লাইওভারে ১ ঘণ্টার বেশি যানজটে আটকে থাকার কথা জানিয়েছেন যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌হানিফ ফ্লাইওভার তৈরি করা হয়েছিল মূলত আশপাশ এলাকাগুলোকে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য। কিন্তু এটা এখন হয়ে গেছে জাতীয় মহাসড়ক থেকে শহরে ঢোকার পথ। ফ্লাইওভারের র‍্যাম্পগুলো যেখানে শেষ হয়েছে, ওই জায়গায় ম্যানেজমেন্ট আমরা ঠিক করতে পারিনি। সেখানে নামার পরই যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানবাহনের যে মিশ্রণ, সেটা তো আছেই। পথচারী পারাপারের জন্যও নেই কোনো সুব্যবস্থা। এ প্রবেশমুখের কেবল একটা জায়গায় নয়, পথে পথেই প্রতিবন্ধকতা।’

ভবিষ্যতে ঢাকার যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান প্রবেশমুখের চাপ আরো বাড়বে জানিয়ে অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আট লেনের এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীতের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতের কাজ চলমান। এটাও এক্সপ্রেসওয়ে মানের হয়ে যাচ্ছে। তার মানে ভবিষ্যতে ঢাকার যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান প্রবেশমুখের চাপ কিন্তু আরো বাড়বে। এখন সবচেয়ে জরুরি হলো ঢাকার এ প্রবেশপথের চাপ কমানো। ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে করতে পারলে কিছুটা সুফল হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা যদি চিন্তা করি, আমাদের এখন সবচেয়ে জরুরি হলো ইনার, মিডল ও আউটার—তিনটি বৃত্তাকার সড়কের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা। এর মধ্যে আউটার বৃত্তাকার সড়কের দক্ষিণ অংশের কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত।’

অব্যবস্থাপনা ও অপ্রতুল অবকাঠামোর কারণে মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে এরই মধ্যে রাজধানীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের আরেক অধ্যাপক ড. সামছুল হক। এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগে থেকেই আমরা বলে আসছি যে এখানে ব্যাকরণগত ভুল হচ্ছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পটি হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। কারণ অল্প কয়েকটা পয়েন্ট দিয়ে এক্সপ্রেসওয়েটি থেকে ঢাকায় প্রবেশের সুযোগ রাখা হয়েছে।’ 

বিষয়টি ব্যাখা করে এ পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‌এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ার আগে এ পথে যানবাহন বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকত। ফলে যানজটটা ডিস্ট্রিবিউট হয়ে থাকত। এক্সপ্রেসওয়ের কারণে এখন কিন্তু কোথাও না থেমেই গাড়িগুলো চলে আসতে পারছে। কিন্তু ঢাকায় প্রবেশ করার মুহূর্তে পড়ছে যানজটের বিড়ম্বনায়। তাই এ ধরনের দ্রুতগতির সড়ক তৈরির আগেই ঢাকার প্রবেশমুখে চাপ কমানোর পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি ছিল। আর এজন্য বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের সুপারিশ তো কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনাতেই ছিল। কিন্তু এটা পরিকল্পনামাফিক না করে যে যার মতো প্রকল্প করছে, যার কোনো ধারাবাহিকতা নেই।’

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে রাজধানীতে আসার আরেকটি পথ বাবুবাজার থেকে কদমতলী হয়ে গুলিস্তান। গুরুত্বপূর্ণ এ প্রবেশপথে এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে একটি ফ্লাইওভার তৈরি করা হলেও সেটি অসম্পূর্ণ। ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের বাবুবাজার এলাকা থেকে শুরু হয়ে ফ্লাইওভারটি গিয়ে ঠেকেছে বুড়িগঙ্গা ঘেঁষা কদমতলী পর্যন্ত। সেটিও আবার রয়েছে ঝুলন্ত অবস্থায়, কোনো সড়কের সঙ্গেই এর সংযোগ নেই। ফলে এটি কোনো কাজে আসছে না। এতে এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর বাবুবাজার-গুলিস্তান পয়েন্টে যানবাহনের চাপ ও যানজট দুটোই বৃদ্ধি বেড়েছে।

এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ঢাকায় ঢোকার পথে তীব্র যানজটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌আমি জানি, এখানে যানজট হয়। তবে ঢাকা শহর তো সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ দেখে না। এটা আমার কনসার্ন না। এটা সিটি করপোরেশন ভালো বলতে পারবে।’ 

‌ঢাকাকে ঘিরে আউটার রিং রোড নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘‌প্রকল্পটির কাজ শুরু করেছি। মুন্সিগঞ্জের সঙ্গে একটা সড়ক নির্মাণেরও উদ্যোগ নিয়েছি। ফতুল্লা-নারায়ণগঞ্জে সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেছি। এগুলো হলে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে কিছু যানবাহন নিশ্চয়ই এসব সড়কে আসবে। তবে এ কাজগুলো সম্পন্ন হতে সময় লাগবে। একই সঙ্গে বাবুবাজার লিংক ফ্লাইওভারের অসম্পূর্ণ কাজও দ্রুত শুরু করা হবে। এটা রিং রোড করার সময় মিলিয়ে করা হবে।’


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন