নেত্রকোনার পাহাড় ও সমতলে কমেছে নৃগোষ্ঠীর বাস

ভজন দাস, নেত্রকোনা

নেত্রকোনায় পাহাড়ি টিলাগুলোয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস থাকলেও এখন অনেকটাই কমে গেছে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলার পাহাড় এবং সমতল ভূমিতে শত শত বছর ধরে বাস করছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সামাজিক প্রথা, পোশাক ও সংস্কৃতি। একসময় পাহাড়ি টিলাগুলোয় তাদের বসবাস থাকলেও এখন অনেকটাই কমে গেছে। ২০১১ ও ২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা কমেছে ১ হাজার ৭৭ জন।

কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির আনুপাতিক হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া, বহিরাগতরা পাহাড় দখল করায় সীমান্তবর্তী এলাকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস কমে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাড়ি জমিয়েছে রাজধানীসহ বড় বড় শহরে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের দাবি, ভারতের মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা দুর্গাপুর ও কলমাকান্দার পাহাড়-অধ্যুষিত ৭৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনপদ। শত শত বছর থেকে এ অঞ্চলের পাহাড় ও সমতল ভূমিতে বাস করে আসছে তারা। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ডালু, মান্দাইসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে পাহাড় ও সমতল ভূমিতে। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সামাজিক প্রথা, পোশাক ও সংস্কৃতি। একসময় ছোট-বড় পাহাড়ি টিলাগুলো ছিল তাদের বসবাসের স্থান। তখন পাহাড়ের রূপ ছিল ভিন্ন। বর্তমানে পাহাড়ে বহু জাতির মানুষ বসবাসের ফলে অতীত ঐতিহ্য হারাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। পাহাড়ি গাছ কেটে রোপণ করা হয়েছে আকাশমমণি। এতে পাহাড়ি প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়িদের সঙ্গে বনের পশু-পাখির সহাবস্থান। প্রভাব পড়ছে তাদের জীবনযাত্রার মানের ওপর। এ কারণে দিন দিন কমে আসছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা।

এ বিষয়ে আদিবাসী লেখক ও গবেষক স্বপন হাজং বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একসময় পাহাড় শাসন করত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা। বর্তমানে কিছু কিছু পাহাড় এবং টিলা বহিরাগতরা দখলে নিয়েছে। এতে তাদের জুম চাষের সুযোগ কমে গেছে। তারা আগে মৌসুমি ফল খেতে ও বিক্রি করতে পারত। আগে বনে বাঁশ ও কলাগাছ ছিল। তখন হাতিরা গভীর বন থেকে এসে বাঁশের ডগা ও কলা গাছ খেয়ে আবার চলে যেত। মানুষের ক্ষতি করত না। এসব গাছ কমে যাওয়ায় হাতি খাবার না পেয়ে ফসলি জমির ক্ষতি করছে। ঘরবাড়ি নষ্ট করছে। মাঝে মাঝে মানুষকেও আক্রমণ করছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নষ্ট হয়ে গেছে পাহাড়ি জলাধারগুলোও। একসময় পরিযায়ী পাখিও আসত পাহাড়ে। শিকারিদের ভয়ে পাখি এখন আর পাহাড়ি বনে আসে না। পাহাড়ি ঔষধি গাছও বিলীন হওয়ার পথে। হারিয়ে গেছে বনের হরিণ, বানর, শিয়াল, খরগোশ, সাপ, ব্যাঙসহ অন্যান্য পশু-পাখি।’

পাহাড়ঘেঁষা সীমান্তবর্তী দুই উপজেলায় রয়েছে হাজংসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা। স্কুল-কলেজে এসব ভাষার তেমন পাঠ্যরূপ না থাকায় দিন দিন তা হারিয়ে যাচ্ছে। তবে ভাষাটি যাতে হারিয়ে না যায় এজন্য এক শিক্ষার্থী টিউশিউনির টাকা বাঁচিয়ে গোপালপুর, লক্ষ্মীপুর, বারমারি ও বিপিনগঞ্জসহ বিভিন্ন গ্রামে শিশু-কিশোরের ভাষা চর্চা করে যাচ্ছেন। হাজংসহ অন্যান্য ভাষাকে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাঠ্যরূপ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ওই শিক্ষার্থী।

আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, ২০১১ সালে দুর্গাপুর উপজেলায় গারো, হাজংসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ ছিল ১১ হাজার ৬৯ জন। কলমাকান্দা উপজেলায় ছিল ১১ হাজার ৬১৩ জন। দুই উপজেলায় মোট জনসংখ্যা ছিল ২২ হাজার ৬৮২ জন। তবে ২০২২ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনায় সে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৬০৫ জনে।

জেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মো. শাহজাহান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী ২০১১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা কমেছে ১ হাজার ৭৭ জন।’ কারণ হিসেবে তিনি আদিবাসীদের নিজস্ব পেশা ছেড়ে জীবিকার তাগিদে অন্যত্র চলে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।

দুর্গাপুর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের ক্লাইভ মারাক বলেন, ‘বিগত দিনে আমাদের গ্রামে প্রায় ১৫০টি নৃগোষ্ঠী পরিবার ছিল। তারা নিজেদের ইতিহাস-ঐতিয্য অনুযায়ী পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে জুম ও অন্যান্য ফলের চাষ করে করত। কিন্তু কালের আবর্তে পাহাড়ি টিলাগুলো প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাওয়ায় দিন দিন বসতি বাড়ছে বহিরাগত অন্য জাতি-গোষ্ঠীর সংখ্যা। জীবিকার তাগিদে তারা পাড়ি জমাচ্ছে ঢাকাসহ অন্য জেলায়।

আদিবাসী এলাকায় বহিরাগতদের বসবাস এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ বলেন, ‘বিষয়গুলো সঠিকভাবে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন