আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির আওতায় নির্দিষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও বাংলাদেশের পক্ষে তা এখন পর্যন্ত পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আগামী মার্চেও যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, বিদ্যমান বাস্তবতায় সেটিও অর্জন করতে গিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এক্ষেত্রে ৩ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ছাড়ের বিষয়টি অনুমোদন হয় ১২ ডিসেম্বর। তবে নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় বাংলাদেশ এ শর্তে কিছুটা ছাড় চাইলে সংস্থাটি তা পুনর্নির্ধারণ করে। সে অনুযায়ী গত ডিসেম্বর শেষে ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন, এ বছরের মার্চ শেষে ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ও জুন শেষে ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে। যদিও গত বছরের ডিসেম্বরের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি গেলেও তা পূরণ সম্ভব হয়নি। এর আগের প্রান্তিক যেমন গত বছরের মার্চ, জুন ও সেপ্টেম্বরেও নিট রিজার্ভ-সংক্রান্ত আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসারে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। নিট রিজার্ভের পরিমাণ আরো কম, ১৬ বিলিয়ন ডলারের মতো। মার্চে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে ১ মাস ২০ দিনের মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভ বাড়াতে হবে। যদিও এ সময়ে কোনো ধরনের বাজেট সহায়তার অর্থ বিদেশী অংশীদারদের কাছ থেকে আসার কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। উল্টো আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) পাওনা পরিশোধ করতে হবে। এতে রিজার্ভ থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ চলে যাবে। ফলে মার্চে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে রিজার্ভে যোগ করতে হবে ৪ বিলিয়ন ডলার। এটিকে বেশ চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমান গতি অব্যাহত থাকলে আগামী মার্চে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রিজার্ভ সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। গ্রস রিজার্ভের চেয়ে আমাদের নিট রিজার্ভের পরিমাণ ৩ থেকে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার কম থাকে। তার ওপর মার্চে আকুর বিল পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের একটি ঘাটতি থাকবে। সেটি পূরণ করে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রিজার্ভ সংরক্ষণ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে।’
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বড় অংকের বাজেট সহায়তা এ সময়ে আসবে এমন কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত নেই। তবে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বাজেট সহায়তা চলমান। সেখান থেকে কিছু অর্থ আসতেও পারে। তাছাড়া মার্চে রমজান ও ঈদ ঘিরে দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়বে। অন্যদিকে সরকারের আমদানি নিয়ন্ত্রণ নীতি বহাল রয়েছে। এতেও কিছু ডলার সাশ্রয় হবে। সব মিলিয়েই রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চেষ্টা থাকবে সরকারের।
রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ক্ষেত্রে লেনদেন ভারসাম্যের (বিওপি) উদ্বৃত্ত থাকার পাশাপাশি দেশের আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমিয়ে আনাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রির প্রবণতায় লাগাম টানা জরুরি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে লেনদেন ভারসাম্যে ৪৯০ কোটি ডলারের ঘাটতি ছিল। একই সময়ে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি বেড়ে ৫৩৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশে মোট ১ হাজার ২৯০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। প্রতি মাসে গড়ে এসেছে ১৮৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৯৯০ কোটি ডলারের রফতানি আয় দেশে এসেছে, যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ কম। একই সময়ে বাংলাদেশ ১ হাজার ৫৬৯ কোটি ডলারের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করেছে, যা এর আগের প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পাওয়ার পরে রিজার্ভ কিছুটা বাড়লেও এর পর থেকে এটি আবারো নিম্নমুখী। আগামী মার্চে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে আমাদের বর্তমান নিট রিজার্ভের সঙ্গে ন্যূনতম আরো ৩ বিলিয়ন ডলার যোগ করতে হবে। রিজার্ভ বাড়াতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে প্রতি মাসে ১০০ কোটি ডলার বিক্রি করছে সেটি বন্ধ করতে হবে। তাহলে রিজার্ভ আর কমবে না। পাশাপাশি বিওপি উদ্বৃত্ত থাকতে হবে এবং আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমাতে হবে। বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলে মার্চের মধ্যে এগুলো বাস্তবায়ন করাটা কঠিন চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া এ সময়ের আগে কোনো ধরনের বাজেট সহায়তার অর্থ আসবে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। গত ১৫ মাসে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় দেশে আসেনি। নির্বাচনের পর এ বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে এ অর্থ দেশে আসবে বলে প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’
কীভাবে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে তার একটি পথ বা গাইডলাইন থাকতে হবে জানিয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সেটি তো দেখতে পাচ্ছি না। রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে রেমিট্যান্স যেমন বাড়বে, অন্যদিকে আমদানিও বাড়বে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ যেটা বেড়েছে সেটি ধরে রাখার পাশাপাশি বিনিময় হারের কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে যে প্রবাসী আয় আসছে না সেটি আনার ক্ষেত্রে কোনো নীতি তো দেখা যাচ্ছে না। অন্তত আগামী মার্চের মধ্যে এ ধরনের কোনো কিছু হবে বলে সেটি মনে হচ্ছে না। অবশ্য গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে রিজার্ভ বাড়ানোর যে চেষ্টা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সেই একই প্রচেষ্টা এ বছরের মার্চের শেষেও দেখা যেতে পারে। এর মাধ্যমে সংখ্যাগতভাবে যদি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সক্ষম হইও তাতে কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে না।’
এদিকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ও শর্ত পরিপূরণ এবং সংস্কার বাস্তবায়ন মূল্যায়ন করে আগামী মে মাসে আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করা হবে। এজন্য আগামী মাসে সংস্থাটির একটি মিশন বাংলাদেশে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মার্চে রিজার্ভ সংরক্ষণের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সেটি পূরণ হবে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না। সে সময় আইএমএফের একটি মিশন বাংলাদেশে আসবে। তাদের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।’