স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষায় ইনভেস্ট করতে হবে

অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া। উপাচার্য, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ)। এর আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দীর্ঘ ২০ বছর বুয়েটের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি দেশের শিক্ষা খাত নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে

কয়েকটি শিক্ষা কমিশন ও নীতিমালা হওয়ার পরও শিক্ষাবিদরা বলছেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো পূর্ণাঙ্গ কাঠামোর মধ্যে আসতে পারেনি। কেন?

আসলে যত কমিশন গঠন করা হয়েছে, সবটাতেই নামকরা শিক্ষাবিদরাই ছিলেন। কমিশনের রিপোর্টও সুন্দর। সবই ভালো, বাস্তবায়নযোগ্য। মূল সমস্যাটি হচ্ছে বাস্তবায়ন। বাস্তবায়ন যদি আমি ঠিকভাবে করি, তাহলে এত কমিশনের দরকার নেই। ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলেই দেখা যেত এ কমিশনগুলো, রিপোর্টগুলো ঠিকভাবে কাজ করত। তাই আসল কথা হলো বাস্তবায়ন।

সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষা আইন, শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামোসহ বেশকিছু সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এ বিষয়গুলোকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

এটা যারা আমাদের কর্তাব্যক্তি আছেন তারা ভালো বলতে পারবেন কেন করেন না। তবে আমি মনে করি কমিশন যখন গঠন করা হয়, তখন ওই রিপোর্টগুলো বাস্তবায়ন করা উচিত। হিমাগারে ফেলে রাখা উচিত না। যারা কষ্ট করে রিপোর্টগুলো করেছেন তারা বাস্তবতার নিরিখে এবং দেখেশুনেই করেছেন। সেজন্যই আমি মনে করি, যখনই কমিশন তৈরি হয় বা আমাদের যেকোনো কমিটি তৈরি হয়, যেগুলো দেখে ভালোমতো বাস্তবায়ন করলে পরে আর ঝামেলা হয় না। আমাদের দুর্ভোগে পড়তে হয় না।

শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবার নিচে। শিক্ষা বাজেট নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

বাজেটে জিডিপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটা পারসেন্টেজ ১ দশমিক ৭ শতাংশ। জিডিপি আমাদের যেহেতু বাড়ছে, তাই পরিমাণের দিক থেকে হয়তো টাকার অংকে বাজেট বাড়ে। কিন্তু পারসেন্টেজে কমে যাচ্ছে, এটা একটা পয়েন্ট। সেকেন্ড পয়েন্ট হলো এই যে টাকার অংক আমরা বলছি ১ দশমিক ৭ শতাংশ, এর মূল খরচটা কোথায় যায়। অবকাঠামো তৈরিতে চলে যায়। স্যালারিতে চলে যাচ্ছে। আমাদের বাজেটের একটা বিশেষ অংশ খরচ করা উচিত গবেষণায়, বিজ্ঞানে। আমাদের গবেষণাগুলো কম। সে জায়গায় আমাদের খরচ করা উচিত। আমাদের শিক্ষার যে খরচ এটাকে খরচ না বলে বিনিয়োগ হিসেবে ভাবতে হবে। আমরা যদি এটাকে বিনিয়োগ হিসেবে চিন্তা করি, তাহলে এ ছাত্র-ছাত্রীরা যখন সুশিক্ষিত হবে তারাই কিন্তু দেশের বাইরে গিয়ে একটা পর্যায়ে আমাদের দেশের জন্য সম্পদ নিয়ে আসতে পারবে। দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য তারাই পথিকৃৎ হবে। শিক্ষা খাতে আমাদের বাজেট আরো বাড়ানো উচিত। অন্তত ইউনেস্কো স্ট্যান্ডার্ডের কাছাকাছি যাওয়া উচিত। তাহলে এ খাতে ইনভেস্ট করতে হবে। ফলে আমরা ২০ বছর, ৩০ বছর পর একটা রিটার্ন পাব। মালয়েশিয়া, কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশ তারা ইনভেস্ট করেছে আরো অনেক আগে এবং তার সুফল পাচ্ছে। সুফল পেতে হলে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে স্মার্ট জনগণ তৈরি করতে হবে। সে স্মার্ট জনগণের তৈরি করতে হলে আপনাকে ইনভেস্ট করতে হবে শিক্ষায়। এর কোনো বিকল্প নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা প্রায় আট লাখের কাছাকাছি। উচ্চ শিক্ষিতরা কেন বেকার থাকছে?

শিক্ষক হিসেবে অনেক জায়গায় নিয়োগের সঙ্গে থাকতে হয়। ইন্টারভিউ নেয়ার সময় দেখা যায় অনেকেরই বেসিক নলেজগুলোর মধ্যে ঘাটতি থাকে। এবার আপনার প্রশ্ন থাকতে পারে স্যার কেন থাকে, আপনারাই তো শিক্ষক। উত্তর হলো আমরা চেষ্টা করি ওদের শেখানোর জন্য কিন্তু দেখা যায় একটা দুর্বলতা থেকে যায়। মূল কারণটা হলো যখন ফিল্ড লেভেলে কাজ করতে যায়, তখন সেখানে যে জ্ঞানটা দরকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সে নলেজের একটা ঘাটতি থাকে। সিলেবাস বা কারিকুলামগুলো একটু ব্যাকডেটেড থাকে। সেটা না করে আমরা যদি ইন্ডাস্ট্রি রিলেটেড বা ওরিয়েন্টেড করে কারিকুলামটা তৈরি করতে পারি এবং সে ধরনের ফিল্ডের পড়াশোনা করাতে পারি, সেই সঙ্গে কোয়ালিটি এডুকেশন যদি দিতে পারি, তাহলে গ্যাপটা থাকে না। 

সম্প্রতি এক জরিপে উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৪২ শতাংশ তরুণ ভালো কর্মসংস্থানের জন্য দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। দেশের যে শিক্ষা ব্যবস্থা সেটি কি এখনো কর্মমুখী না?

আসলে এখানে শুধু কর্মমুখিতা নয়, আমাদের এখানে সোশ্যাল সিকিউরিটিও গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে কিন্তু আমাদের দেশের তরুণরা যে যেভাবে পারছে বিদেশে চলে যাচ্ছে। অনেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ আমাদের কর্মসংস্থানেরও অনেক ঘাটতি। আমি পাস করে বের হচ্ছি কিন্তু আমি যদি আমার মতো করে চাকরি না পাই, তাহলে দেখা যাবে যে আমি খুঁজব কোথায় সুযোগ আছে। আমাদের কর্মসংস্থানও তৈরি করতে হবে। আমাদের এখানে যে ইন্ডাস্ট্রিগুলো তৈরি হচ্ছে, সেখানেও যেন আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা কাজ করতে পারে। সে ব্যাপারেও আমাদের মনোযোগী হতে হবে। বাইরে যেতে চাচ্ছে কেন? সেখানে সুযোগ আছে, এখানে সুযোগ তৈরি করলে তারা দেশেই থাকবেই। আইটি সেক্টরে অনেক ছাত্র-ছাত্রী কিন্তু বাইরে যায় না। অপরচুনিটি পাচ্ছে, দেশে বসেই কাজ করতে পারছে। ফ্রিল্যান্সিং করতে পারছে। ফলে অপরচুনিটি পেলে সে দেশ ছেড়ে যাবে না। হয়তো অল্প কিছু যাবে।

উচ্চশিক্ষা খাতে কোনো সংস্কার প্রয়োজন আছে কি?

সংস্কার বলতে আমাদের এখানে কারিকুলামটা ভালোমতো তৈরি করতে হবে। সেভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াতে হবে। ভালো শিক্ষক ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তারা কাজ করার পরে যেন প্রথম দিন থেকেই কোনো একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারে। সেভাবে তাদের তৈরি করে দিতে হবে। তাহলেই তারা কাজ করতে পারবে এবং ইন্ডাস্ট্রি তাদের গ্রহণ করবে। আমাদের এ ইন্ডাস্ট্রি ছোট ছোট। এখানে যদি ছয় মাস একজনকে শুধু ট্রেনিং করানো হয় এবং সে অন্যদিকে চলে যায় তাহলে ইন্ডাস্ট্রিগুলো আর বড় হতে পারবে না। সব মিলিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আমরা থার্ড বা ফোর্থ ইয়ারে কিছু কোর্স বা কিছু ট্রেনিং চালু করতে পারি, যার মাধ্যমে তারা ডে ওয়ানেই জব মার্কেটে প্রবেশ করতে পারে বা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাহলে আমি মনে করি, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের যে সমস্যা এটা থাকবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন