পটচিত্রে বাংলার চিরায়ত গল্পের বুনট

আহমেদ দীন রুমি

বেঙ্গল স্ক্রল ছবি: আর্ট অব দ্য আর্থ

ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসী। নালিশ নিয়ে এল গ্রামপ্রধানের কাছে। এক অতিকায় বিকট দৈত্য দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গ্রামময়। বিষয়টি চিন্তিত করে মোড়লকে। তিনি দ্রুত এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন দানবটিকে হত্যা করার জন্য। লোকটি বুদ্ধি খাটিয়ে খুব সন্তর্পণে দানবের গুহায় একটা আয়না রেখে দিলেন। ফলাফল দেখা গেল অল্প সময়ের মধ্যেই। দানবটি আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে অন্য কোনো দানব এসেছে বলে ধরে নিল। প্রবল আঘাতে হত্যা করতে চাইল প্রতিদ্বন্দ্বীকে। আর তাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আয়না ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। আর প্রতি টুকরাতেই দেখা যেতে থাকল একটা করে দানব। উদ্বেগে নিজের পরাজয় ধরে নিয়ে আত্মহত্যা করল দানবটি। বিজয়ীর বেশে ফিরল বুদ্ধিমান ব্যক্তিটি। তার বিজয়ের কথা ছড়িয়ে দিতে চাইলেন মোড়ল। ফের নতুন বুদ্ধি নিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি নিজেই। মানুষকে ধরে ধরে গল্প শোনানোর চেয়ে তিনি এক টুকরো কাপড়ের মধ্যে পুরো গল্প চিত্রিত করলেন। কাপড়ের টুকরায় চড়ে সে বিজয়গাথা ছড়িয়ে পড়লে দূরে বহুদূরে। আর এভাবেই জন্ম নিল পটচিত্র নামে এক শিল্পকলা। গল্পটির পেছনে সত্যাসত্য যতটুকুই থাক; পটচিত্র যে বাংলার চিত্রকলার প্রাচীন ধারা, বিষয়টি ফুটে ওঠে স্পষ্টভাবেই।

পটুয়া, পোটা পুটুয়া নামে পরিচিত ধারার সঙ্গে জড়িত চিত্রশিল্পীরা। তাদের বুনটে সতেজ হয়ে ওঠে পুরাণ, স্থানীয় লোককাহিনী, সুফি ভাবধারা সমসাময়িক বিষয়বস্তু। প্রথম দিকে পটুয়ারা সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রকৃতিকে আঁকতেন শুকনো পাতা কাপড়ের গায়ে। পরবর্তী সময়ে বিষয়বস্তুর পাশাপাশি পরিবর্তন এসেছে রঙ মাধ্যমেও। পটুয়া ঘরানার উৎপত্তি নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যথেষ্ট কঠিন। দশম একাদশ শতাব্দীর বলেও দাবি করেন কেউ কেউ। তবে দৃশ্যমান দলিল পাওয়া যায় ১৮ শতাব্দীর দিকের। বাংলার গ্রামে গ্রামে পটুয়ারা ঘুরে বেড়াতেন পিঠে স্ক্রল নিয়ে। অভিজাতদের বাড়িতে গিয়ে স্ক্রল প্রদর্শনের পাশাপাশি চলত অভিনয়। তাদের কৃতকর্মের জন্য বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করতেন অভিজাতরা। এভাবে জন্ম নেয় পটের গানও। ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের মতো পটের গানেও ত্রিপদের নীতি অনুসরণ করা হয়। আগের আমলে পটুয়ারা দক্ষ হতেন অঙ্কন থেকে অভিনয় করা পর্যন্ত। কিন্তু সময়ের আবর্তনে বদলে গেছে ধরন। বর্তমানে পটুয়াদের কেউ কেউ কেবল গায় কিংবা অভিনয় করে, আর কেউ কেবল আঁকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাদের আঁকার বিষয়বস্তুতেও বৈচিত্র্য বিদ্যমান। সাধারণত প্রাধান্য থাকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ধর্মমঙ্গলের মতো মঙ্গলকাব্য। এছাড়া বেহুলা লখিন্দর, চৈতন্যের মহাপ্রয়াণ, কৃষ্ণলীলা, গাজী কালু, সত্যপীরের মতো বিষয়াবলিও ঠাঁই পায় পটচিত্রে। পাশাপাশি সমসাময়িক বিষয়াবলির সংযোজন পটচিত্রকে সব সময়েই প্রাসঙ্গিক করে রাখে। উদাহরণ হিসেবে, সুফি গল্পের আদলে বর্ণিত হয় লৈঙ্গিক বর্ণের সমতার কথা। আধুনিক পটুয়াদের আঁকাতে দুর্ভিক্ষ, বন্যা, নির্বাচন, জন্মনিয়ন্ত্রণ, এইডস, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সন্ত্রাসবাদের মতো বিষয়াবলি উঠে আসছে সহজেই। থাকে উদ্ভিদ প্রাণিজগতের বৈচিত্র্য। শিল্পীরা তাদের নিজস্ব স্ক্রল ক্যানভাস তৈরি করে, যার পেছনে সময় লাগে এক-দুই সপ্তাহ। তারপর সেখানে স্থানীয় রঙের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়। অঙ্কনেরও কয়েকটি ধারা থাকে। দিঘল পট হলো প্রায় ১০ থেকে ৪০ ফুট লম্বা স্ক্রল। অন্যদিকে চৌকস পট বর্গাকৃতির, যা সাধারণত কোনো দেবতার প্রশস্তি হিসেবে থাকে।  

চিত্রকলার অন্যান্য ধারা থেকে পটচিত্রকে খুব দ্রুতই আলাদা করে শনাক্ত করা যায়। আকর্ষণীয় গৃহনির্মাণ রঙে ভরা চিত্র এবং সাদাকালো নাটকীয় অলংকরণে সজ্জা যেন তুলে ধরে বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যকে। সামাজিক, পৌরাণিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, পরিবেশগত জাতিগত পরিচিতি হিসেবে বহুভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে পটচিত্রকে। পটচিত্রের এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু সত্যপীর। পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের লোকজ ঐতিহ্যের বড় উপাদান সত্যপীর। পীরের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে স্থানীয় বিশ্বাস। ফুটে উঠেছে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি হিন্দু-মুসলিম সামাজিক ধর্মীয় মিথস্ক্রিয়ার এক স্বতন্ত্র সাক্ষ্য। গাজীর পটে গাজী কালু-চম্পাবতীর কাহিনী গাজী পীরের বীরত্বব্যঞ্জক কর্মকাণ্ড অঙ্কিত হয়। গাজীকে কখনো দেখা যায় সুন্দরবনের রাজার সঙ্গে লড়াই করতে; কখনো বাঘের পিঠে আসীন অবস্থায়। তার এক হাতে চামর এবং অন্য হাতে তলোয়ার বা মুষ্টিঘেরা জ্যোতি। গাজীর পটে মানিকপীর, মাদারপীর, সত্যপীর, কালুফকির, বনবিবি প্রভৃতি সম্পর্কে নানা অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের ছবিও থাকে। এরূপ ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি নানা কৌতুক, রঙ্গরসসংবলিত কাহিনী, ব্যঙ্গচিত্র এবং সামাজিক দুরবস্থার চিত্রও অঙ্কিত হয়। কখনো কখনো প্যাঁচা, বানর, গরু, বাঘ, সাপ, কুমির গাছপালাও স্থান পায়। সাঁওতালি পট এদিক থেকে অনেকটাই আলাদা। সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবন, বিশ্বাস পুরাণকে তুলে আনা হয় এক্ষেত্রে। তাদের বিশ্বাস ব্যবস্থা এবং নানাবিধ আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বিষয়বস্তুগুলো। সাঁওতাল পটুয়া শিল্পীরা বিহার এবং ঝাড়খণ্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসতেন তাদের আঁকা ছবি বিক্রি করতে। ক্রমে তাদের গতিবিধি কমে গেলে বাংলার পটুয়ারাই তাদের জানা গল্পের মাধ্যমে সাঁওতাল চিত্রকলার নিজস্ব সংস্করণ তৈরি করতে শুরু করে।

মনসামঙ্গলের প্রধান চরিত্র দেবী মনসা। তাকে কেন্দ্র করে বাংলার উর্বর অঞ্চলে গড়ে উঠেছে মনসা পট। প্রায়ই রোগ নিরাময় এবং উর্বরতা প্রদানের জন্য পূজা করা হয়। মনসা হলেন লোকজ দেবী। তাকে চিত্রিত করা হয় সাপের সিংহাসনে আভিজাত্য নিয়ে বসে থাকা এবং জমকালো গহনা পরা দেবী হিসেবে। গল্পগুলো সাধারণত মধ্যযুগীয় পাঠ মনসামঙ্গলকাব্য থেকে নেয়া হয়। বিশেষ মনসা পটে উল্লেখযোগ্য যে গল্পের অংশগুলো চিত্রিত করা হয়েছে, যা সাধারণের বাইরে। মনসামঙ্গলের বাইরে গিয়ে যমপট আরেকটি সমকালীন পটচিত্র। যমপট সাধারণত অসৎ সৎ গুণের ধারণা প্রচার করে। সৎ জীবনযাপনকে উৎসাহিত করে অসৎ জীবন থেকে দূরে থাকার তাগিদ দেয়। যমপটে বলা হয় পুরাণের মৃত্যুর দেবতা যমের কথা। যম মানুষের কর্মের মূল্যায়ন করে স্বর্গ নরক বরাদ্দ করেন। ভয়ংকর ভৃত্যদের দ্বারা যমের পরিচালিত নরককে চিত্রিত করে যমপট। পটচিত্রের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় নজরে রাখার মতো। ঔপনিবেশিক আমলে আঠারো উনিশ শতকে কলকাতায় চলে এসেছিল অনেক শিল্পী। জীবনের তাগিদে তারা সেখানে তখনবাবু সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে থাকেনবাবু পট আকারে। ঔপনিবেশিক শক্তির নিষ্ঠুরতাওসাহেব পট আকারে চিত্রিত করতে শুরু করেন। কলকাতার কালীঘাট মন্দিরের আশপাশে জন্ম নেয়া চিত্রকলা ক্রমে কালীঘাট পটচিত্র হিসেবে পরিচিত হতে থাকে। বিষয়বস্তু পৌরাণিক কাহিনী থেকে সমসাময়িক ঘটনার দিকে এবং দীর্ঘ আকারের আখ্যান থেকে সংক্ষিপ্তভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। পটুয়ারা অভিযোজিত উন্নত করেছে তাদের চিত্র অঙ্কনের ধারা। তাদের অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরেছে সমাজের নিষ্ঠুর নির্মম চেহারা।

পটচিত্র ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরনো চিত্রকলা ঘরানার একটি। যদিও এটা আধুনিক সময়ে সবচেয়ে অবক্ষয়মুখী শিল্প। তবে সমকালীন বাংলায় পটচিত্র হাজির হয়েছে নতুন আবেদন নিয়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন