আপন ঘরে পরের আমি

একটি সত্তাসন্ধানী শিল্পপ্রদর্শনী

আলম খোরশেদ

মোস্তফা জামান এদেশের একজন অত্যন্ত মৌলিক ও মেধাবী দৃশ্যশিল্পী, শিল্পসমালোচক ও চিন্তক। সম্প্রতি লালমাটিয়ার দ্বীপ গ্যালারিতে তার পরিকল্পনা ও গ্রন্থনায় আপন ঘরে পরের আমি শীর্ষক একটি দলীয় প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। একটি স্বল্পশ্রুত বাউল গান থেকে ধার করা প্রদর্শনীর শিরোনামটিই বলে দেয়, এতে আপন ও পর; ঘর ও বাহির; আমি ও অপর এসব যুগ্ম বৈপরীত্যের আধারে শিল্পীরা তাদের আরাধ্য শিল্প-আধেয়কে পরিবেশনে প্রয়াস পাবেন। প্রদর্শনীর কিউরেটর মোস্তফা জামানের লিখিত বক্তব্যে এমন উদ্যোগের অন্তর্গত বিষয় ও ভাবনাটুকু ভাষা পেয়েছে নিম্নোক্ত ধরনে, যা নিজেই একটি স্বতন্ত্র শিল্প ডিসকোর্স হয়ে ওঠার দাবি করতে পারে।

আপন সত্তায় অপর কী করে জন্ম লয় তা হয়তো সাধু-সন্ত-ফকিরদের জানা আছে। দুই বাংলার ইতিহাসের আলোকে নিশ্চিত করে বলা চলে শিল্প যে আমির মধ্যে না থেকে অন্য আমি সন্ধানের ক্ষেত্র হতে পারে তা কবি রবীন্দ্রনাথের ছবিতে সবার আগে টের পাওয়া গেল। কবির পরিচিত জগতে এ ছিল অন্য আরেক জগতের আকারায়নের উৎসব। আমাদের কালে শিল্পভাষার সাধারণ গণিতের মধ্যে যদি নতুন গণিত আমদানি করতে হয়, তা এই অপরের সন্ধান না করে সম্ভব হবে না। কারণ নতুনত্ব হিসাবের অতীত অংক করে করে তা গড়ে তোলা যায় না। আমি, বিশেষ করে প্রচারমুখী আমি জাগতিক হিসাব--নিকাশের সূত্রে নিঃসন্দেহে এক নিরেট পাথরে পরিণত হয় অতি সহজে। ‘‌আপন ঘরে পরের আমি’ আপাত স্বাভাবিকতানির্ভর এ মত শিল্পীসত্তার বাইরের আমিকে হাজির করার প্রকল্প।

দীর্ঘ এ উদ্ধৃতির শেষ বাক্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আমরা এতকাল জেনে এসেছি, একজন শিল্পীর শিল্পসত্তাকে খুঁজে পেতে হলে সর্বাগ্রে ডুব দিতে হবে তার আপন সত্তার গভীরে। অথচ আলোচ্য প্রদর্শনীর উদ্দিষ্ট নাকি ‘আপাত স্বাভাবিকতানির্ভর এ মত শিল্পীসত্তার বাইরের আমিকে’ অনুসন্ধান। তার এ ব্যতিক্রমী ও বহুস্তরী শৈল্পিক-বৌদ্ধিক প্রকল্পটিতে যে ১২ জন শিল্পী ও ভাবুক এমন আত্মিক অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন তারা হলেন: মোস্তফা জামান স্বয়ং, আতা মজলিশ, সুবর্না মোর্শেদা, রাজীব দত্ত, ইমরান সোহেল, সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির, মো. জোবায়ের হোসেন জ্যোতি, সালমা আবেদীন পৃথি, আফসানা শারমিন ঝুমা, আবীর সোম, কাজী তাহ্সিন আগাজ অপূর্ব ও তাইয়ারা ফারহানা তারেক। তারা প্রত্যেকেই নিজের মতো করে তাদের নিজস্ব অস্তিত্বচিন্তা, আত্মজিজ্ঞাসা ও শিল্পভাবনার বিচিত্র ও বহুমুখী বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছেন ‘‌দ্বীপ’ নামক এ দ্ব্যর্থাত্মক চিত্রশালার পরিসরটুকুজুড়ে।

এদের মধ্যে একজন কাজী তাহ্সিন আগাজ অপূর্ব, তো তার ব্যক্তিগত শিল্পের ঘরটিকেই তুলে নিয়ে এসেছিলেন এ ‘দ্বীপ’-এর বুকে এবং নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে সে ঘরের দখল ছেড়ে দিয়েছিলেন অপর, তথা প্রদর্শনীতে আগত দর্শক, শিল্পরসিকদের কাছে। আর এভাবেই যেন তার ব্যতিক্রমী শিল্পের মাধ্যমে আপন-পরের নিজস্ব বোঝাপড়াটুকু সেরে নিতে চাইছিলেন। অনেকটা একই রকম কাজই করেছেন আফসানা শারমিন ঝুমা, তবে নিজস্ব শিল্পঘরের পরিবর্তে তিনি একেবারেই আটপৌরে এক অন্দরমহলের প্রাত্যহিক খুঁটিনাটি দিয়ে সাজিয়েছিলেন তার শিল্পের পসরা, যার প্রধান উপাদান ছিল একটি বিচিত্র আয়না। বস্তুত এ বিদগ্ধ দর্পণটিই যেন হয়ে ওঠে শিল্পীর এবং সেই সঙ্গে দর্শকেরও নিজেকে দেখার ও শেখার, খোঁজার ও বোঝার, সর্বোপরি অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয় বিষয়ক বোঝাপড়ার এক নতুন মাধ্যম। ঘর নিয়ে কাজ করেছেন সুবর্না মোর্শেদাও, তবে একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে। তিনি ‘ঘর থেকে ঘরে’ শিরোনামে আস্ত একখানি হস্তনির্মিত বইই বানিয়ে ফেলেছেন, যে গ্রন্থের পাতায় পাতায় রয়েছে তিনি এ জীবনে যত ঘরে থেকেছেন তার ছবি, তাকে ঘিরে যত স্মৃতি ও ভাবনার বিচিত্র অভিব্যক্তি। 

এই ঘর ও বাহির, আপন ও পরের যুগ্ম বৈপরীত্যের পাশাপাশি স্রেফ নিজেকে নিয়ে; নিজের চেহারা, শরীর, স্বাস্থ্য, মুখ ও মুখোশের রাজনীতি নিয়েও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম রয়েছে এ প্রদর্শনীতে। সেসবের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় প্রদর্শনীর কিউরেটর খোদ মোস্তফা জামানের কাজটির কথা, যার নাম তিনি রেখেছেন Enforced Appearance, বাংলায় যাকে হয়তো আমরা বলতে পারি জবরদস্তি আবির্ভাব। এটি মূলত একটি স্থাপনা শিল্প, যেখানে শিল্পী তার তোলা অনেক পোস্টারের মুখকে মূলত রাজনীতিবিদ, স্বঘোষিত সমাজসেবী, প্রচারকামী নেতা-পাতিনেতাদের বাঁধাই করে গ্যালারির মেঝেতে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে রেখে তার ওপর জ্বালিয়ে দিয়েছেন একটি করে মোমবাতি। যেন তিনি তাদের উদ্দেশে বলতে চাইছেন, তোমাদের এসব জোর করে দেখানো শ্রীমুখগুলোর গন্তব্য শেষ পর্যন্ত এ ধরাতল, আমাদের জ্বালিয়ে দেয়া শোক ও সান্ত্বনাবাতির আলোটুকু ছাড়া যেগুলো আদতে অর্থহীনই। আমাদের এ শরীরী আত্মপ্রেমের বিষয়টি নিয়েই অনেকদিন কাজ করছেন তরুণ দৃশ্যশিল্পী মো. জোবায়ের হোসেন জ্যোতি। তার তোলা দেশের বিভিন্ন সরকারি ব্যায়ামাগারে নিয়মিত চর্চাকারী ব্যায়ামবীরদের কিছু বিচিত্র ভঙ্গিমার ছবি প্রদর্শিত হয়েছে এখানে, যার ভেতর দিয়ে দেহ ও দেহবাদী ধারণার এক নতুন মাত্রা উন্মোচিত হয়। জ্যোতির মতোই আলোকচিত্র মাধ্যম নিয়ে কাজ করেছেন সালমা আবেদীন পৃথি, যিনি একটি কল্পিত পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাদের টানাপড়েনের ছবির মধ্য দিয়ে বুঝতে ও বোঝাতে চেয়েছেন ঘরে ও বাইরের, আপন ও পরের এক অন্যরকম আটকাহন।

এর বাইরে রাজিব দত্তের বুদ্ধিদীপ্ত ভিডিও ইনস্টলেশন, ইমরান সোহেলের কবিত্বময় অণুভাস্কর্য ও কাইনেটিক (গতিপ্রবণ) আর্ট, সৈয়দ মোহাম্মদ জাকিরের অভিনব ফেলাছড়ার শিল্প তথা ফাউন্ড আর্ট, তাইয়ারা ফারহানা তারেকের একগুচ্ছ দৃষ্টিনন্দন মিনিমালিস্ট আর্ট ইত্যাদির মধ্যস্থতায় শিল্পীচতুষ্টয় নিজের ভেতর দিয়ে অন্যকে এবং অন্যের ভেতর দিয়ে নিজেকে দেখার ও পুনরাবিষ্কারের প্রয়াস পেয়েছেন। আবীর সোম অবশ্য এসব কোনোকিছুরই ধার ধারেননি। তিনি সবকিছু ভেঙে পড়া এ দারুণ দুঃসময়ে আমাদের আরেক আরম্ভের জন্য প্রস্তুত হওয়ার মন্ত্রণা দিতে চান তার নজরকাড়া অথচ নাজুক, আপাতভঙ্গুর অথচ ইঙ্গিতময় লাল-সাদা স্থাপনা শিল্পটির মাধ্যমে। আমরা কি প্রস্তুত আমাদের আপন ঘরের সেই পরের আমিকে বরণ ও মননে ধারণ করার জন্য?

পুনশ্চ: ১/১, লালমাটিয়া, ঢাকায় অবস্থিত দ্বীপ গ্যালারিতে প্রদর্শনীটি চলবে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত, প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন