গণিতের ৪২২ ও ইংরেজির ৪১০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক একজন

ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও এর গুণগত মানের উন্নতি খুব বেশি হয়নি বলে মনে করছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। শিক্ষক সংকট তার অন্যতম কারণ। মাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণত শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:৩০। অর্থাৎ প্রতি ৩০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ন্যূনতম একজন শিক্ষক থাকবেন। অথচ বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রতিবেদন বলছে, মোট শিক্ষক-শিক্ষার্থী আদর্শ অনুপাতের কাছাকাছি থাকলেও ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় শিক্ষক সংকট অত্যন্ত প্রকট। এর মধ্যে গণিতের ৪২২ ও ইংরেজির ৪১০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন একজন। আর বিজ্ঞানে তা আরো বেশি—১০২১ শিক্ষার্থীর পাঠদানে আছেন কেবল একজন শিক্ষক। 

ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক যেসব বিষয় পড়ানো হয়, সেগুলোর শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক সংখ্যা তুলনা করে দেখা গেছে, তুলনামূলক কঠিন বিষয়গুলোকে কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের অর্ধেকেরই বেশি সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম, লাইব্রেরি বিজ্ঞান ও শারীরিক শিক্ষার। অন্যদিকে বর্তমানে আইসিটিতে মোট ১ কোটি ১৩ লাখ ৩১ হাজার ১৪৩ শিক্ষার্থীর বিপরীতে এখন শিক্ষক রয়েছেন ১৪ হাজার ৭১২ জন। সে হিসেবে প্রতি ৬৮৯ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন একজন। বাংলা, ইংরেজি ও গণিতেও সমসংখ্যক শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে এর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন যথাক্রমে ২২ হাজার ১৫৩ জন, ২৪ হাজার ৭০২ জন ও ২৩ হাজার ৯৯৬ জন। এ হিসাবে বাংলায় ৪৫৭, ইংরেজিতে ৪১০, গণিতে ৪২২ শিক্ষার্থীকে মাত্র একজন শিক্ষক পাঠদান করেন। 

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে শিক্ষক সংখ্যা কম থাকায় অনেক সময় এমন শিক্ষকরাও এসব বিষয় পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন, যারা স্নাতক পর্যায়ে তা পড়ে আসেননি। ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে ফলাফলেও। মাধ্যমিক পর্যায়ে যারা অকৃতকার্য হচ্ছে তাদের বড় অংশই ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান বা আইসিটিতে অকৃতকার্য হচ্ছে।

মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়ে মোট শিক্ষার্থী ৭২ লাখ ৪৩ হাজার ২৬২ জন। বিদ্যালয়গুলোর তথ্য অনুযায়ী সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষকরাই এ বিষয়টি পড়িয়ে থাকেন। এ বিষয়ে মোট শিক্ষক রয়েছেন ৩৫ হাজার ৯৫৬ জন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২১০। আর বিজ্ঞান সাধারণত পড়িয়ে থাকেন ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষকরা। বর্তমানে বিজ্ঞানে মোট শিক্ষার্থী ৮৯ লাখ ৭২ হাজার ৭১২ এবং এর বিপরীতে ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষক রয়েছেন ৮ হাজার ৭৯১ জন। এ বিষয়ে প্রতি ১ হাজার ২১ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। এছাড়া ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষায় প্রতি ৩২৯ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন।

নবম ও দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যের বিভাগভিত্তিক বিষয়গুলোয় এ সংকট আরো প্রকট। শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভূগোলে মোট ১৯ লাখ ৫৭ হাজার ৫৩৯ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ৬৯৩ জন। অর্থাৎ মানবিক শাখার গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে প্রতি ২ হাজার ৮২৫ শিক্ষার্থীকে পাঠদানে রয়েছেন মাত্র একজন শিক্ষক। বিভাগভিত্তিক বিষয়গুলোর মধ্যে শুধু ভালো অবস্থানে রয়েছে জীববিজ্ঞান। এ বিষয়ে মোট ৬ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ১০ হাজার ৬০৫ জন। অর্থাৎ প্রতি একজন শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করে ৬৫ শিক্ষার্থী। 

শিক্ষা পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে মোট ২ লাখ ৭৮ হাজার ৬০৮ শিক্ষকের মধ্যে সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম, বাংলা, কৃষিবিজ্ঞান, শারীরিক শিক্ষা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি এবং লাইব্রেরি বিজ্ঞানের শিক্ষক রয়েছেন ১ লাখ ৪১ হাজার ১৪৮ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষক সমাজবিজ্ঞানে, ৩৫ হাজার ৯৫৬ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিক্ষক ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষায়। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের মোট শিক্ষক সংখ্যা ৩০ হাজার ৬৫৫ জন। এছাড়া শারীরিক শিক্ষায় ১৮ হাজার ১৮২, কৃষিবিজ্ঞানে ১৭ হাজার ৪০, লাইব্রেরি বিজ্ঞানে ১৪ হাজার ২১৩, গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে ১ হাজার ২১০ ও চারুকলায় ১ হাজার ২৪৯ শিক্ষক রয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. অহিদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভাষাগত শিক্ষকের সংকট সব দেশেই রয়েছে। তবে আমাদের দেশে শুধু ভাষা নয়, সবক্ষেত্রেই শিক্ষক সংকট—এটি কাম্য নয়। বিশেষ করে বিদ্যালয়গুলোয় অনেক সময় দেখা যায়, যিনি আইসিটি পড়াচ্ছেন, গণিত বা ইংরেজি পড়াচ্ছেন তিনি সে বিষয়ে স্নাতক করেননি। ফলে শিক্ষার্থীরা যা শিখছে সেখানে ঘাটতি থাকছে। এ চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।’ 

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ উপাচার্য আরো বলেন, ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং জিডিপিতে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এখন আমাদের সবক্ষেত্রে আইসিটি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমি মনে করি এ বিষয়ে ভালো শিক্ষক পেতে শিক্ষা ক্যাডারে আইসিটি যুক্ত করা উচিত।’ 

গণিত ও ইংরেজি পড়ান এমন শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ব্যানবেইসের প্রকাশিত তথ্যেও শিক্ষাবিদদের এ কথার প্রমাণ মিলেছে। সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের ৮০ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই। ২০২২ সালে প্রকাশিত এ তথ্য অনুযায়ী দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯৬ হাজার ৫৮ শিক্ষক ইংরেজি পড়াতেন। এর মধ্যে কেবল ৬ হাজার ২৪১ শিক্ষক ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রিধারী। আর এ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ছিলেন ৯ হাজার ৪১ শিক্ষক। সে হিসেবে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের ৮৪ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ডিগ্রি নেই।

একই চিত্র দেখা যায় গণিতের ক্ষেত্রেও। বিদ্যালয়গুলোয় সর্বমোট ৬৭ হাজার ৯৫৫ গণিতের শিক্ষক ছিলেন জরিপের ওই বছর। তবে এর মধ্যে মাত্র ৫ হাজার ৮৪৩ জন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক ও ৭ হাজার ২৮৫ শিক্ষক গণিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা। সে হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে ডিগ্রি রয়েছে কেবল ১৯ শতাংশ শিক্ষকের। বাকি ৮১ শতাংশই অন্য বিষয়ে ডিগ্রিধারী।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হালিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গুণগত শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত ১:৩০ হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের যে বিপুল জনশক্তি, এত শিক্ষার্থী অনেক ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেলেও আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারিনি। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, শিক্ষার সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত শিক্ষকও নিয়োগ দিতে হবে।’ 

ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থী-শিক্ষকের আনুপাতিক হারকে খুবই দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অন্য বিষয়গুলো বাদ দিয়ে শুধু বাংলা ও ইংরেজির কথা বললেও এটাকে হতাশাব্যঞ্জক বলতে হবে। শিক্ষার প্রধান ও প্রথম উপকরণ হচ্ছে ভাষা। এর মাধ্যমেই তো আমরা আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকি। বাংলা মাতৃভাষা হিসেবেও আমাদের চর্চা করা উচিত এবং আমাদের জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হওয়া উচিত। এ ভাষার প্রতি গুরুত্ব না দেয়া হলে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের জগতে প্রবেশে বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হবে এবং এরই মধ্যে হচ্ছে। ইংরেজি আমাদের দ্বিতীয় ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারে প্রবেশ করতে হলে এবং জ্ঞানভাণ্ডার থেকে জ্ঞান অন্বেষণ করতে হলে ইংরেজির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।’ 

মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষায় যেতে চায় না মন্তব্য করে এ শিক্ষাবিদ বলেন, ‘আপনি শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে পড়াবেন কীভাবে? রাষ্ট্রের উচিত ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করা। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কম, তাদের ক্ষমতা নেই, শিক্ষক নিয়োগে মনোযোগ নেই। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা দিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে ও সামাজিকভাবে সম্মান দিতে হবে। নাহলে পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব হবে না।’ 

মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক সংকটের বিষয়টি মন্ত্রী-উপমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায়ের সবাই অবগত বলে জানান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক মো. বেলাল হোসাইন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে শিক্ষক সংকটকে। বিদ্যমান এ সংকট দ্রুততম সময়ের মধ্যে কীভাবে দূর করা যায় এ বিষয়ে শিগগিরই আলোচনা করা হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের হাতে নয়। বিদ্যালয়গুলো তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী শূন্য পদের বিপরীতে চাহিদা দেয় এবং সে অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া হয়। তবে শিক্ষক সংকটের বিষয়টি যেহেতু উপরমহলের সবাই জানেন যদি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের বিষয়ে কোনো কিছু করণীয় থাকে তারা নিশ্চয়ই পদক্ষেপ নেবেন।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন