বুড়িগঙ্গা...

গঙ্গাবুড়ির চিঠি

ওয়াহিদ সুজন

বুড়িগঙ্গা থেকে ‘গঙ্গাবুড়ি’। খোদ এ নদী বা গঙ্গার সঙ্গে ভক্তি-পুরাণের যে সম্পর্ক, তাতে বোধ হয় কিছুটা চপল ও লঘু শোনায়! আপাতত যা জানা গেল, কফিল আহমেদের জনপ্রিয় গান থেকে শব্দটি নেয়া। ঢাকা রাজধানী যার কোলঘেঁষে সেই নদীকে নিয়ে কিউরেটোরিয়াল প্রকল্প ‘গঙ্গাবুড়ি’। এ প্রদর্শনীতে প্রবহমান ঐতিহ্য, কল্পনা ও যাপন দৃশ্যশিল্পের নানান ফর্মে উঠে এসেছে। সাতজন দৃশ্যশিল্পী ছাড়াও গবেষণা ও অন্যান্য অনুষঙ্গের দিক থেকে রয়েছে বিস্তর জনসম্পৃক্ততা। কিউরেট করেছেন শেহজাদ শাহরিয়ার চৌধুরী।

বুড়িগঙ্গা, তার যেকোনো গল্পই এখন দূষণ বিযুক্ত নয়। এ অঘটনকে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি থেকে কতটাইবা আলাদা করে দেখা যায়! আমিনুল ইসলাম আশিকের ‘ফ্লো অব ড্রিম’ সেই প্রবহমানতা তুলে ধরেছে। নগরসভ্যতার জননী বলা হলেও নদী কালে কালে কীভাবে দূষণে নিজেকে পাল্টে ফেলে তার উদাহরণ বুড়িগঙ্গা। এটি মানবিক জুলুমও। জুলুম এমন এক বিষয়, মানুষ যখন মানুষের ওপর করতে থাকে, তা থেকে ছাড় পায় না প্রকৃতিও। মানুষ নিজেকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে। ব্রোঞ্জ-কাদামাটির এ ইনস্টলেশনে আছে প্রবহমানতা, দূষণ গিলে খাচ্ছে নদীর ধর্ম, প্রাণ-প্রকৃতিকে। বোধগম্য রূপক হিসেবে আছে সাকার মাছ। আর সাকার দলের কালো অবয়বের ভেতর ডালাভর্তি চকচকে মাছ। এভাবে দুটো ভিন্ন সময়, লক্ষ্য ও আশাবাদ তুলে ধরেন আশিক।

 এ গল্প এমনই সময় এল, যখন আন্তর্জাতিক পরিসরে কপ২৮ সম্মেলনে এক হয়েছেন বিশ্বনেতারা। আর বুড়িগঙ্গার যেকোনো গল্প এখন জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে এগোয়। ফলে বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশনে আয়োজিত প্রদর্শনী ঘিরে বিদেশী ছয়-সাত সংস্থার লোগো অনভ্যস্ত লাগে না।

এ ধরনের প্রদর্শনীতে শিল্প ও অ্যাক্টিভিজম বরাবর দাগ টানা যায় কিনা? কথা প্রসঙ্গে বৃহত্ত্বর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী বলছিলেন, এ ধরনের কাজে একজন সচেতন মানুষ বা শিল্পী হিসেবে বড় ভূমিকা থাকতে পারে। আমরা তো অ্যাক্টিভিস্ট না। শিল্পীর প্রকাশভঙ্গি আলাদা হয়। এটা এক ধরনের প্রতিবাদও হতে পারে। এটা খুব প্রতীকীভাবে, রূপকভাবে ঘটে। অন্য কোনো সময়ে আমরা হয়তো এটি অনুধাবন করতে পারব। এখন যেমন জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবি অন্যভাবে ভাবাতে পারে। যাকে আমরা শুধু দুর্ভিক্ষের মধ্যে রাখছি না। 

নদীমাতৃক বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘ল্যান্ডস্কেপের’ বদলে ‘ওয়াটারস্কেপ’ও বলা যায়। এমন একটি মন্তব্য ছিল বিশ্বজিতের। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা জলের ওপর বসবাস করছি। বুড়িগঙ্গার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক—এর ভেতর দিয়ে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। স্থাপনার দিকে মোগল আমলের স্থাপত্যের কথা বলতে পারি। আবার নদীতে কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ জল নিচ্ছে, এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে যাচ্ছে, এ যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে নদীর সঙ্গে তার যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, নদীইবা সেটাকে কীভাবে দেখছে! নদীর সঙ্গে আমাদের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক—প্রকৃতি, নদীর সঙ্গে সম্পর্ক একধরনের আশা নিয়ে বাঁচার প্রেরণা দেয়। পুরো প্রজেক্টের ভেতর সেটা আছে।’ 

অবশ্য অবকাঠামো ও স্থানিক পরিসরে গঙ্গাবুড়ির সঙ্গে বৃহত্ত্বর সম্পর্ক জুতসই লাগে। গ্যালারিটির অবস্থান হাজারীবাগে, যা আমাদের নগর পরিকল্পনাগত ত্রুটি-বিচ্যুতির ভালো উদাহরণ। ট্যানারির কারণে প্রতিবেশগতভাবে বিপন্ন হয়ে ওঠা এলাকাটির এখন খোলনলচে বদলে গেছে। আগের মতো দূষণ না থাকলেও এখানকার অবকাঠামো, সাইনবোর্ড, যান্ত্রিক শব্দ বা বাতাসে ওড়া ঘ্রাণ বলে দেয় চামড়া শিল্পের সঙ্গে এ এলাকার সম্পর্ক। বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশনের অবস্থান একটি ট্যানারির ছাদে অবস্থিত। ভিন্ন এ উদ্যোগের সঙ্গে পরিচিতি আছে এলাকাবাসীর। আমরা যখন এক রিকশাচালককে মুক্তি ট্যানারির হদিস জিজ্ঞাসা করছিলাম; একবাক্যে বললেন, সামনের ওই গলি। সঙ্গে সম্পূরক প্রশ্ন; স্টুডিওতে যাবেন? এ গল্প বলছি এ কারণে যে ট্যানারির ছাদে তৈরি গ্যালারি বুড়িগঙ্গা নিয়ে গল্প সাজাবে তা-ই তো স্বাভাবিক।

প্রদর্শনীতে ঢোকার মুখেই চোখ যায় ইটের তৈরি একটা শিল্পকর্মের দিকে, শিরোনাম ‘ইটাগঙ্গা’। নির্মাণ করেছেন মো. খাইরুল আলম সাদা। ইটের নৌকাটির মাঝ বরাবর ভাঙা—নদী ও শহরের সেই সম্পর্ক, যারা পরস্পরকে ভেঙেচুরে গড়ে দেয়। না গড়েছে শহর, না বইছে স্রোতঃস্বিনী। নদীকে আমরা জীবন্ত সত্তাই বলি। আর একটি সত্তা আরেকটি সত্তাকে গড়ে উঠতে বা ভেঙে পড়তে সাহায্য করবে। একেকটি সভ্যতা যেমন প্রকৃতিকে ধ্বংস করে তৈরি হয়—প্রকৃতি যখন ধ্বংস হয়, একাই ধ্বংস হয় না। আপনি যখন বুড়িগঙ্গা ধরে এগোবেন, পানি হয়তো স্পর্শ করতে চাইবেন না। কিন্তু বাতাসও আপনাকে দূষণ থেকে নিস্তার দেবে না। 

কিছুদিন আগে নিজের নদীকেন্দ্রিক প্রদর্শনী নিয়ে আলাপচারিতায় শিল্পী হামিদুজ্জামান খান বলছিলেন, ‘ঢাকা এমন অবস্থায় চলে গেছে যে নদীর দিগন্তরেখা ঠেলে ঢুকে পড়েছে দালানকোঠা।’ সভ্যতা আর ইট-পাথরকে পরিপূরকভাবে দেখার যে চল, তার খামতি নতুন করে বলার নয়। এদিক থেকে ‘ইটাগঙ্গা’য় ধারণ করা অসহনীয় ভার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

‘জলের গল্পটা কি অদ্ভুত না? তোমার জীবন শুরু যেখানে ৯৯ শতাংশ জল দিয়ে, ক্রমান্বয়ে জন্মলগ্নে তা হয় ৯০ শতাংশ জল। প্রৌঢ়ত্বে আসলে তা হয় ৭০ শতাংশ। যে জল শরীরে শক্তি বহনকারী রূপে কাজ করে সেই জলেরই আছে তথ্য অনুকরণ ও স্মৃতি ধারণ করার ক্ষমতা। জীবনের জন্য যেমন প্রয়োজন পানির, সভ্যতার জন্য তেমনি প্রয়োজন নদীর। তাই আমিই জল—আমিই তুমি’—আয়োজকদের দেয়া ফোল্ডারে লেখা গঙ্গাবুড়ির দীর্ঘ চিঠির অংশ এটি। প্রদর্শনীতে এ মিথস্ক্রিয়ার অন্য রূপ দেখা গেল। দর্শকদের সামনে থাকছে নদীর কাছে চিঠি লেখার সুযোগ। তাতেই মিলল শিশুদের আঁকা ছবি। এঁকে দেখিয়েছে নদীকে তারা কীভাবে লালন করে। ছবি যদি অবচেতনের বহিঃপ্রকাশ হয়, তার অধিষ্ঠান তো আরো গভীরে, যেখানে আছে পুরাণ-আদিকল্প। আমাদের বর্তমান, ঐতিহ্য ও কল্পনাকে ভাষা দিতে সক্ষম তারা। যার উপস্থিতি আছে ‘গঙ্গাবুড়ি’তে। 

অনন্যা মেহপার আজাদের ‘শীতলক্ষ্যার সাতকাহন’। যেখানে জলের মতো স্বচ্ছ মসলিনে কারচুপির কাজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পুরাণ। সেই গল্প চিঠির ভাষায় এমনই, ‘লোকে বলে জল নাকি স্মৃতি ধারণ করে। স্মৃতির পলি আর সময়ের তালে তুমি-আমি ক্রমাগত বদলে যাই। দাপ্তরিক নথিতে আমার জন্ম কলাটিয়ার ধলেশ্বরী থেকে হলেও আমার ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের গল্প শুরু ব্রহ্মপুত্র ও পরশুরামের পৌরাণিক আখ্যান থেকে। আমি স্রোতঃস্বিনী চপলা শীতলক্ষ্যা, আমি বৃদ্ধা গঙ্গা।’ 

গ্রাফিকস বুকের আদলে বুড়িগঙ্গা তীরের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন শামীম আহমেদ চৌধুরী, শিরোনাম ‘এপাড়-ওপাড়’। ২০১০ সালের শীতের সকালে মেয়ে হারানো এক বাবার অনুসন্ধান এ দৃশ্যশিল্পীকে আন্তরিকভাবে লিপ্ত করে। মানবিক সম্পর্কের রহস্যময়তার সমান্তরালে নদীও হয়ে ওঠে চরিত্র। যেখানে হারিয়ে খুঁজে ফেরার সঙ্গে জড়িয়ে যায় নদীতীরের জীবন। ‘এপাড়-ওপাড়’ দেখা-অদেখার গল্প। দর্শক হিসেবে হঠাৎ হঠাৎ দু-একটি শব্দ চমকে দেয়। যেমন ‘হঠাৎ ঘাটে চিৎকার...সাহায্যের চিৎকার’। শুধু কি মানুষ সাহায্য চায়। নদীরও সাহায্য দরকার পড়ে! 

আছে আহমেদ রাসেলের ‘মেমোরিজ অব ওয়াটার’ শিরোনামের ফটো সিরিজ। ২০১৫ সালে ক্যামেরা হাতে তার যাত্রা। তীর ধরে এগোতে এগোতে আটপৌরে জীবনের সব দৃশ্য জড়ো করেছেন, যা সিরিজ আকারে অসামান্য হয়ে উঠেছে। ‘কাউরা’ নামের প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছেন কাজী সাইদুল করিম টুলু। শামুকের আকৃতিতে বাঁশের তৈরি এ প্যাভিলিয়ন প্রদর্শনীতে এক রহস্যবস্তু। অতীত-বর্তমানের মেলবন্ধন ও অরগানিক-আর্টিফিশিয়ালের ভেদবিচার। এ স্মৃতি-বিস্মৃতির মাঝে আশাবাদ যে নেই তা নয়। প্রকৃতি নিজে নিজেই সারিয়ে নেয়, এমন অনেক উদাহরণ হয়তো আমরা দিতে পারি। এমনও হতে পারে উষ্ণায়ন ও দূষণের করালে সবকিছু ভেঙেচুরে নিজেকে নতুনভাবে সাজাবে পৃথিবী। কিন্তু সেখানে মানুষের অবস্থা কেমন দাঁড়াবে? তার বিলুপ্তি ঘটবে না তো! সেই অনুমান ছাড়াও মানুষ তার প্রতিবেশকে নিয়ে নতুন নতুন আশা দিয়ে সাজায়। তারই একখণ্ড চিত্র নূর এ আলা সিদ্দিকের ‘মেটামরফোসিস’। ইট ও প্লাস্টিকজুড়ে তিনি বানিয়েছেন শুঁয়োপোকার ডানা মেলার গল্প।

এসব গল্প আর যেকোনো গল্পের মতো সরল নয়, ভাবনার ক্ষেত্রেও নয়। শিল্পের আত্মা ছোঁয় কিনা তাও একটি প্রশ্ন। তবে এটা নিশ্চিত যে আমাদের সামনে নদী ও মানুষের মিথস্ক্রিয়া যখন আসে, তখন আমরা আসলে আগের মানুষটা আর থাকি না, তখন নদীটাও পাল্টে যায়। শিল্প, প্রকল্প ও বাস্তবতার দোদুল্যমান জগতে তার অবস্থান নতুন নতুন অভিমুখ তৈরি করবে। আপাতত এটুকুই ‘গঙ্গাবুড়ি’।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন