নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে বছর শেষ করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর

রাশেদ এইচ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

ডলার সংকট, উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধি ও কাঁচামালের সরবরাহ সংকটসহ নানা কারণে লক্ষণীয় মাত্রায় কমেছে পণ্য আমদানি। ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় রফতানির চিত্রও নিম্নমুখী। ফলে চলতি বছরের পুরোটা সময়ই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। 

বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। বন্দরে জাহাজ ভেড়ার পরিমাণও ছিল তুলনামূলক কম। নিম্নমুখী আমদানি-রফতানির কারণে ব্যাহত হয়েছে রাজস্ব আহরণ। 

চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১১ মাসে বন্দরে ২৭ লাখ ৮১ হাজার ৮৮৮ টিইইউ (টোয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিটস) কনটেইনার পরিবহন হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ লাখ ২১ হাজার ২২৮ টিইইউ কম। অর্থাৎ কনটেইনার পরিবহন কমেছে ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দরে গত বছর কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩১ লাখ ৪২ হাজার ৫০৪ টিইইউ। 

এদিকে আমদানি কমে যাওয়ায় রাজস্ব আদায়ের লক্ষমাত্রা থেকে পিছিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। রাজস্ব আহরণে এনবিআরের পক্ষ থেকে সংস্থাটিকে চলতি অর্থবছরের জন্য ৭৭ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩১ হাজার ৭২০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ২৮ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১১ দশমিক ৬১ শতাংশ কম আহরণ হয়েছে। শুধু নভেম্বরেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ শতাংশ কম আদায় হয়েছে। 

ক্রাউন সিমেন্ট পিএলসির ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) প্রেসিডেন্ট মো. আলমগীর কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে রাজস্ব আয় সরাসরি সম্পর্কিত। বর্তমান যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে সবচেয়ে বড় ভিকটিম ব্যবসায়ী মহল। ডলার সংকটের কারণ ছাড়াও টাকার অবমূল্যায়নে ব্যাপক কারেন্সি এক্সচেঞ্জ লস এবং কাঁচামালের আমদানিতে ঋণপত্র খোলার অনিশ্চয়তা সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এখন নতুন করে শুরু হয়েছে ব্যাংক খাতের দুরবস্থা। যেখানে লোকাল কারেন্সিরও ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায়ীরা দেউলিয়া হয়ে যাবেন।’ 

চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাণিজ্যিকভাবে আমদানি হওয়া ১ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা মূল্যের পণ্যে শুল্কায়ন করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। এই চার মাসে ফার্নেস অয়েল আমদানি হয়েছে ৯ লাখ ৮৪ হাজার টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ লাখ টন বা ২৯ শতাংশ কম। ঢেউটিনের কাঁচামাল হট রোলড কয়েল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার টন। অর্থাৎ এটির আমদানি ৮ শতাংশ কমেছে। সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানি ৫১ লাখ ৩১ হাজার টনে নেমেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ কম। অপরিশোধিত সয়াবিন আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৬৪ টন, যা গত অর্থবছরে ছিল ২ লাখ ২ হাজার ৩১৮ টন। অর্থাৎ এটির আমদানি কমেছে ১৮ শতাংশ। লুব্রিকেটিং অয়েল আমদানি হয়েছে ১৮ হাজার ৪৬৫ টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৩ হাজার ৬০৮ টন। আমদানি কমেছে ২১ শতাংশ। এই চার মাসে পলিভিনাইল ক্লোরাইড আমদানি হয়েছে ৮৬ হাজার ৪৪৩ টন। গত অর্থবছরে একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ৬ হাজার টন। অর্থাৎ আমদানি কমেছে ১৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ডিজেল আমদানি ২৫ শতাংশ কমে ১১ লাখ ৮২ হাজার টনে নেমেছে।

উৎপাদন খাতে যুক্ত শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী কেউই আমদানিতে সক্রিয় হতে পারছেন না। আবার চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামনে নতুন করে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ডেল্টা এগ্রোফুড ইন্ডাস্ট্রিজ ও সিকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভোগ্যপণ্য, শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল প্রতি বছর বেশ বড় পরিমাণে আমদানি হয় দেশে। সংকটে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমদানি কমেছে। সেই ধারাবাহিকতায় উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ অব্যবহৃত থাকছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঝুঁকি আরো বড় করে তুলছে।’

পণ্যের ক্রয়াদেশ কম না বেশি, সেটি মূলত বোঝা যায় ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশনের (ইউডি) হিসাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে। রফতানি বাজারের জন্য পোশাক তৈরির কাঁচামাল আমদানি করতে ইউডি সনদ দেয় তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবং নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। বিজিএমইএর ঢাকা ও চট্টগ্রাম জোনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি নভেম্বরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম জোন মিলে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে কারখানাগুলোকে দেয়া ইউডির অর্থমূল্য ছিল ২০৬ কোটি ৩ লাখ ১৮ হাজার ডলার। অক্টোবরে এই অর্থমূল্য ছিল ২৪১ কোটি ২২ লাখ ২ হাজার ডলার। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানেই ইউডির অর্থমূল্য হ্রাস পেয়েছে ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। 

ওয়েল গ্রুপের পরিচালক ও তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ কম থাকায় কাঁচামাল আমদানি কমেছে। হালনাগাদ ইউডির তথ্য দেখলেই বোঝা যাবে পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন