বিআইডিএসের সম্মেলন ‌‌

ব্যাংকে সুশাসনের অভাব থেকে তৈরি হচ্ছে খেলাপি ঋণ —গভর্নর

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘‌ব্যাংকের সুশাসনের অভাব থেকেই খেলাপি ঋণ তৈরি হচ্ছে। ঋণ নিলে আর দিতে হবে না—এমন একটি কালচার তৈরি হয়েছে। আমরা এটা কমিয়ে আনতে রোডম্যাপ করেছি। আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। এটা বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে। নীতি সুদহারও বাড়ানো হয়েছে।’

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের সমাপনী দিনে গতকাল এক প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে এ কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। রাজধানীর একটি হোটেলে বৈশ্বিক ও দেশের অর্থনীতির অনিশ্চয়তা এবং পলিসি চ্যালেঞ্জ নিয়ে এ বিশেষজ্ঞ প্যানেল আলোচনার আয়োজন করা হয়। এতে সঞ্চালনা করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এছাড়া আলোচনায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাবেক সিনিয়র সচিব শরিফা খান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হানসহ খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ-গবেষকরা। 

আলোচনায় গভর্নর তার বক্তব্যে বলেন, ‘চলমান অর্থনৈতিক ‌সংকট মোকাবেলায় আমরা শক্ত রাজনৈতিক অঙ্গীকার দেখছি। এখানে কোনো ঘাটতি নেই। ব্যাংকিং কোম্পানি আইন পাসের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছে। তাছাড়া আর্থিক খাতের কোম্পানি আইন হয়েছে।’ 

মূ্ল্যস্ফীতি, মুদ্রার বিনিময় হার ও খেলাপি ঋণ অর্থনীতির প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, ‘‌ব্যাংকের সুশাসনের অভাব থেকেই খেলাপি ঋণ তৈরি হচ্ছে। ঋণ নিলে আর দিতে হবে না—এমন একটি কালচার তৈরি হয়েছে। আমরা এটা কমিয়ে আনতে রোডম্যাপ করেছি। আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। এটা বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে। নীতি সুদহারও বাড়ানো হয়েছে।’ 

তবে মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করা হবে না জানিয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘আমরা অনেক অর্থনীতিবিদের সঙ্গে আলাপ করেছি। তাদের পরামর্শের আলোকেই এটিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘‌মূলত বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ ও এফডিআই কমে যাওয়ায় আর্থিক হিসাবে সমস্যা তৈরি হয়েছে। এ অর্থবছরের শেষে এটি সমাধান হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া অর্থনীতির চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স, কৃষি ও পোশাক খাত সঠিক পথেই আছে। আর ঋণ পরিশোধেও আইএমএফ দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের কোনো ঝুঁকি দেখছে না।’ 

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘‌সংকটের সময় ব্যক্তি খাতে বিদেশী ঋণ না নেয়াটাই ভালো হবে।’

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় প্রবৃদ্ধি কমে যায় উল্লেখ করে ড. শামসুল আলম বলেন, ‘‌আমরা এখন প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়ে বেশি জোর দিচ্ছি। সরকার আর টাকা ছাপাচ্ছে না। আর অর্থমন্ত্রীর জন্য আলাদা একজন উপদেষ্টা প্রয়োজন।’

বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‌পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে অনেক সময় অপ্রয়োজনে সিন্ডিকেটের ওপর দোষ দেয়া হয়। ডিমের দাম বেড়েছিল উৎপাদন কম হওয়ায়। পোলট্রি খাদ্যের দাম বাড়ায় সার্বিক ডিম উৎপাদন কমেছিল। তবে সিন্ডিকেট নেই, তা বলা যাবে না।’ 

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, ‘‌রাজনৈতিক নেতারাই শুধু পলিসি ঠিক করে না। তারা কর্মকর্তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে থাকে। আর সরকারের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় করাটা রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়। সেক্ষেত্রে এটা জরুরি।’ 

তিনি বলেন, ‘‌নেতাদের একা পলিসি গ্রহণের সুযোগ বিশ্বের কোথাও নেই। আর বিশ্বে সবচেয়ে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকও পুরোপুরি স্বাধীন থাকে না।’ 

সরকারের সাবেক সিনিয়র সচিব শরিফা খান বলেন, ‘‌অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি। এর পেছনে কৃষি এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত এখানে বড় ভূমিকা রাখছে। তাই কর বাড়ালে এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত প্রভাবিত হবে। আর ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা আছে বলেও বিদেশীরা আরো ঋণ দিতে চায়। ২০২৬ সালের পর বিদেশী ঋণ ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। তাই এর আগেই সব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করাটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হবে। আর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অনেক কথা হলেও সতর্ক থেকে এগুলো ম্যানেজ করা যাবে।’ 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ তার বক্তব্যে বলেন, ‘‌দীর্ঘদিন আমাদের ডিম, আলু, মুরগি আমদানি বন্ধ ছিল। আমরা ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আবার মূল্য বাড়ায় আমদানির অনুমতি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে এনেছি।’

প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‌মুদ্রার বিনিময় হার, ব্যাংকের সুদহার ও নিম্ন কর আহরণ বর্তমান অর্থনীতির তিনটি স্বল্পমেয়াদি সংকট। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় মাত্র ৮ শতাংশ কর আহরণ দিয়ে কখনো উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হওয়া সম্ভব নয়। আর এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। নির্বাচনের পর রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি সংস্কারে হাত না দেয় তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত নয়, বরং নিজেদের স্বার্থেই আর্থিক খাতের সংস্কার জরুরি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিন বলেন, ‘‌সরকারের বাইরে আলাদা একটি স্বাধীন পলিসি অ্যাডভাইজার বডি থাকা দরকার, যেখানে সমাজের বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞরা একত্রিত হয়ে কাজ করবেন। আর শিক্ষার্থীদেরও পলিসি নিয়ে পড়ানো উচিত।’ 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‌বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সাময়িক সমাধানের মাধ্যমে আলোচনার উপসংহার টানলে চলবে না আমাদের। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রয়োজন, নইলে এত ঋণখেলাপি কীভাবে কমবে?’

আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় জাতীয়তাবাদভিত্তিক একটি ভাবাদর্শ থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির। তিনি বলেন, ‘‌সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় দেশের চেয়ে আন্তর্জাতিক পরিসর বেশি সক্রিয়। এখন বৈদেশিক সব ঋণচুক্তি পুনর্বিবেচনা করে দেখতে হবে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন