ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথের উদ্বোধন শেষে বিশেষ ট্রেনে চড়ে ভাঙ্গা স্টেশনে পৌঁছান। ভ্রমণকালে তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে তিনি ফটোসেশনে অংশ নেন ছবি: পিএমও

‘আজকের দিনটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য আরেকটি গর্বের ও আনন্দের দিন। যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আজ যুক্ত হলো নতুন একটি মাইলফলক। আজ পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের শুভ উদ্বোধন হচ্ছে। এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো।’ গতকাল মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজংয়ের মাওয়া রেলওয়ে স্টেশনে আয়োজিত ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এর আগে গতকাল সকালে সড়কপথে মাওয়া পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। মাওয়া স্টেশনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর একটি বিশেষ ট্রেনে চড়ে দুপুর ১২টা ৪৯ মিনিটে তিনি ভাঙ্গা স্টেশনের দিকে রওনা দেন। ৫৪ মিনিট পর বেলা ১টা ৫৫ মিনিটে ট্রেনটি গন্তব্যে পৌঁছায়।

ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়টি জেলা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোরকে সংযুক্ত করবে। প্রথম ধাপে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা অংশ সমাপ্তির মধ্য দিয়ে নতুন তিনটি জেলা মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় এল।’

সরকারপ্রধান বলেন, ‘সব দেশী-বিদেশী চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আমরা নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। গত বছর এ সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আজ পদ্মা সেতু দিয়ে শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল। স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচলের মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ পেল একটি নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী যোগাযোগের মাধ্যম। এ মেগা প্রকল্পটি দেশের জিডিপি ১% বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। ভবিষ্যতে ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও আমরা গ্রহণ করেছি।’ 

ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের অংশ হিসেবে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রড গেজ মেইন লাইন, ২৩ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ (ভায়াডাক্ট) এবং ৫৪ কিলোমিটার লুপ ও সাইডিং লাইনসহ প্রায় ২২৭ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি গ্রহণ করে ২৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে ফাস্ট ট্র্যাক তালিকাভুক্ত করা হয়। ১৪ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে আমি এ প্রকল্পের গ্রাউন্ড ব্রেকিং করি।’ 

তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্পে রেললাইন ছাড়াও নির্মাণ করা হচ্ছে সুপরিসর ওয়েটিং রুম, নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক টয়লেট, যাত্রীদের ওঠানামার সুবিধার্থে লিফট, এস্কেলেটর, বেবি কেয়ার কর্নারসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ১৪টি নতুন স্টেশন। মানোন্নয়ন করা হচ্ছে ছয়টি রেলওয়ে স্টেশনের। এরই মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ৬০টি মেজর ব্রিজ, ১৪৪টি কালভার্ট, ১২৮টি আন্ডারপাস। ২০টি স্টেশনে স্থাপন করা হচ্ছে আধুনিক কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিগন্যালিং ব্যবস্থা। ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গায় নির্মাণ করা হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন ও সুবিশাল ওভারহেড স্টেশন। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত স্টেশন এলাকায় ও রেললাইনের দুই পাশে রোপণ করা হচ্ছে ১০ লক্ষাধিক ফলদ, বনজ ও ঔষধি প্রজাতির গাছ। প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কিমি মেইন লাইন ও ২৭ কিমি লুপ লাইন নির্মাণ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত এবং সম্পূর্ণ পাথরবিহীন এ রেললাইনের সর্বোচ্চ গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ১২০ কিমি। প্রকল্পের আওতায় চীন থেকে ১০০টি ব্রড গেজ কোচ এরই মধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। কোচগুলোয় সংযোজন করা হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা, স্লাইডিং ডোর এবং পরিবেশবান্ধব বায়ো-টয়লেট।’ 

গত ১৫ বছরে যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা একদিনে ১০০ সড়ক ও ১০০ সেতু উদ্বোধন করেছি। গত বছর ডিসেম্বরে আমরা মেট্রোরেল এবং ৭ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের উদ্বোধন করেছি। আমরা এমনভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করছি যাতে বাংলাদেশ শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, এশিয়ান হাইওয়ে, এশিয়ান রেলওয়ে এবং আন্তর্জাতিক এভিয়েশন হাবের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বাংলাদেশের প্রথম টানেল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন শিগগিরই জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। শুধু যোগাযোগ খাতেই নয়, আমরা কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রতিটি সেক্টরে গত ১৫ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে উন্নীত করেছি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে এবং অতিদারিদ্র্যের হার ২৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। আমাদের মাথাপিছু ২ হাজার ৭৬৫ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমরা ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮ লাখ ২৯ হাজার ৬০৭টি ভূমিহীন পরিবারকে বিনামূল্যে জমিসহ বাড়ি প্রদান করেছি। আমরা প্রথমবারের মতো দেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছি। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই এ ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেকেরই জমি ও বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আপনারা সহযোগিতা করেছেন। আপনাদের এ ত্যাগ জাতি চিরদিন মনে রাখবে। আমি পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নে নিয়োজিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি), ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান এক্সিম ব্যাংক অব চায়না, দেশী-বিদেশী প্রকৌশলী, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও নির্মাণ শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, ‘একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং রূপকল্প ২০২১-এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের জন্য উন্নয়নের অগ্রদূত প্রধানমন্ত্রী রেলকে আধুনিক, নিরাপদ, আরামদায়ক, সময়োপযোগী, কৃষকবান্ধব ও পরিবেশবান্ধব পরিবহন হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বাত্মক চেষ্টা এবং সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন। তার পরামর্শ ও দিকনির্দেশনায় রেলপথ মন্ত্রণালয় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যার অন্যতম হলো রেল ব্যবস্থাকে প্রত্যেকটি জেলার সঙ্গে সম্প্রসারিত করা ও দুই ধরনের রেল ব্যবস্থা অর্থাৎ মিটার গেজ ও ব্রড গেজকে সমন্বয় করে এককভাবে ব্রড গেজে রূপান্তর করা, সিঙ্গেল লাইনকে ডাবল নাইনে রূপান্তর করা, এছাড়া পূর্বাঞ্চলের রেল ব্যবস্থার সঙ্গে পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের রেলকে সংযুক্ত করা।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন