শিক্ষাসফর

জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণে যবিপ্রবির পরিবেশবিদ্যার শিক্ষার্থীরা

এ টি এম মাহফুজ

বিশ্ব একটি বই। যারা ভ্রমণ করে তারাই কেবল বইটি পড়তে পারে। বেঁচে থাকার জন্য মনের আনন্দ দরকার। সেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় ভ্রমণ করার মাধ্যমে। আর তা যদি হয় শিক্ষাসফর, তাহলে আনন্দের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যায়। 

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের একটি কোর্স বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন অ্যান্ড ইকোট্যুরিজম। এ কোর্সের ব্যবহারিক কাজের অংশ হিসেবে ৪০ জনের একটি পর্যবেক্ষক দল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সিলেটের নানা উদ্ভিদ ও প্রাণীর অভয়ারণ্য জাফলং, লালাখাল, তামাবিল, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, মাধবকুণ্ড ও শ্রীপুর ভ্রমণ করে। সেখানের আদর্শ ট্যুরিজম স্পট ম্যানেজমেন্ট, মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক কারণে পরিবেশের ওপর সর্বোপরি জীববৈচিত্র্যের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে তা অনুধাবন করা, পানির ও মাটির গুণগত মানসহ সার্বিক পরিবেশগত অবস্থার পর্যবেক্ষণ এবং নমুনা ও তথ্য সংগ্রহ করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। 

এছাড়া বায়োডাইভারসিটি ইনডেক্স (স্যানন ইনডেক্স, সিম্পসন ইনডেক্স) দিয়ে প্রতিটি প্রজাতির উদ্ভিদের ঘনত্ব বের করে আগের ও বর্তমান অবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা, জনবসতি এলাকায় মানুষকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ক্যাম্পেইন করা। যাত্রারম্ভে মেডিকেল ফার্স্ট এইড বক্স, রোড ম্যাপ, ভ্রমণ শিডিউল, জরুরি নাম্বার তালিকা এবং সব সদস্যের পরিচয়পত্র সংগ্রহে নেয়া হয়। 

সিলেট থেকে জাফলং ৬২ কিলোমিটার। জৈন্তাপুর পর্যন্ত অপরূপ হাওরের সৌন্দর্য খুবই উপভোগ্য। প্রকৃতিকন্যা জাফলং স্বচ্ছ পানি আর চকচকে নুড়িপাথরসহ অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর। আসামের সবুজে ঘেরা পাহাড় এ সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দেয়।

জাফলং: আগস্ট-সেপ্টেম্বরে যে জায়গাগুলো পানিতে পূর্ণ থাকার কথা, সেখানে বেশির ভাগ জায়গাই পানিশূন্য। আগে নৌকা দিয়ে গিয়ে ট্রলারে ওঠা লাগত। এখন হেঁটেই যাওয়া যায়। উপনদীর পানির সেই গতি এখন আর নেই। জাফলংয়ে আগে যেসব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য মানুষ ছুটে যেত, সেসব এখন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। দর্শনার্থীদের ব্যবহার করা খাবারের প্যাকেট ও প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ধরনের বর্জ্যের মাধ্যমে পানি ও মাটি দূষিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টি সঠিকভাবে না হওয়ায় পানিশূন্যতায় জাফলংসহ বিভিন্ন স্থানে অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্তির পথে। এ কারণে তাদের জীবনচক্রে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। 

রাতারগুল ও বিছনাকান্দি: রাতারগুল সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি মিঠাপানির জলাবন। এ জলাবনের আয়তন ৩ হাজার ৩২৫ দশমিক ৬১ একর। একে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এখানের পানির গুণগত মান পরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করতে পাঁচজন করে মোট আটটি দল গঠন করা হয়। প্রতিটি দল বোতলে পানির নমুনা সংগ্রহ করল, যা পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে। রাতারগুলে নৌকায় ভ্রমণের সময় গান ও কবিতায় মেতে ছিল সবাই। চারপাশে উঁচু উঁচু গাছ ঘিরে রেখেছে খালগুলোকে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে রাতারগুলের সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করা যায়।৷

লাউয়াছড়া: লাউয়াছড়া এরিয়া থেকে মাটির ওপরের পাতা ও রিসিডিউ সরিয়ে ৬ ইঞ্চি গভীর থেকে ১৫ মিনিট অন্তর প্রতিটি গ্রুপ মাটির নমুনা সংগ্রহ করে। ল্যাবে এসব নমুনা পর্যবেক্ষণ করে মাটির গুণাগুণ, মান ও বিষাক্ততা শনাক্ত করা যাবে। লাউয়াছড়ার একজন গাইড দলটিকে আধা কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করান এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করেন। ১ হাজার ২৫০ হেক্টর আয়তনবিশিষ্ট লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রায় সব মিলিয়ে ১০০-১২০ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রায় ৪০-৫০ প্রজাতির প্রাণী দেখা যায়। এখনো কোনো প্রাণী মরার রেকর্ড নেই, তবে অনেক উদ্ভিদ প্রজাতি মরে যাচ্ছে। লাউয়াছড়ার উদ্ভিদের বায়োডাইভারসিটি ইনডেক্স দেখে যেসব উদ্ভিদ ও প্রাণী সংখ্যায় কম বা বিলুপ্তির পথে সেগুলো খুঁজে বের করে তার সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মাটি ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রজাতিগুলোর বিলুপ্তি ঠেকাতে হবে।৷

ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট: এখানে সাদা পাথর স্থানটি ঘুরে দেখার সময় বিভিন্ন ধরনের পাথর ও এর ছবি সংগ্রহ করা হয়। অসাধারণ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ জায়গাটি। পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে পানির বয়ে চলা স্বর্গসম।

পর্যবেক্ষণ দলের সদস্য, পরিবেশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াসিম খান বলেন, ‘আমরা স্বচক্ষে সেখানকার বর্তমান বায়োডাইভারসিটি, মাটি, পানি ও সার্বিক ট্যুরিজম ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়েছি। বিভিন্ন স্যাম্পল কালেক্ট করেছি, যেন সেখানকার মাটি ও পানির গুণগত মান বুঝতে পারি, কোনো বিষাক্ত মাইক্রো ও ম্যাক্রো প্লাস্টিক, হেভি মেটাল আছে কিনা। সেগুলো অ্যাকুয়াটিক বায়োডাইভারসিটি এবং সারফেস বায়োডাইভারসিটিতে বিরূপ কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য।’ 

আরেক শিক্ষার্থী তাসমিত রাফা বলেন, ‘আমি মনে করি একাডেমিক সুবিধার পাশাপাশি শিক্ষাসফর শিক্ষার্থীদের আজীবন স্মৃতি তৈরি করার সুযোগ দেয়। এ সফর আমাদের নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে সহযোগিতা করেছে। আমাদের জ্ঞানের সীমা বাড়িয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন