গার্মেন্টস সেক্টর এগোনোর পেছনে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের অবদান রয়েছে

গার্মেন্ট সেক্টর এগোনোর পেছনে আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের অবদান অনেক বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে দেশের মোট রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। গত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?

প্রথমত, এ ৫০ বিলিয়ন ডলার হওয়ার পেছনে বড় কারণ কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধি। আগে যে তুলার দাম ছিল ১ টাকা, এখন হয়েছে দেড় টাকা। ৫০ বিলিয়ন হওয়ার পেছনে এটা একটি বড় ফ্যাক্টর। আমদানি মূল্য ও আমদানি ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে। এ কারণে এখানে বেনিফিট পাওয়া গেছে, অর্থাৎ ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানিতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আমদানি মূল্য এবং ব্যয় বৃদ্ধির প্রতিফলন রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, কোয়ান্টিটি বেড়েছে। করোনার পর ব্যাপক অর্ডার। কিন্তু এর আগে দীর্ঘ সময় চারদিক অবরুদ্ধ ছিল। অবশ্য তখনো আমরা মেশিনারিজ কিনেছি। উদাহরণস্বরূপ জাপানের একটি কোম্পানির কাছে মেশিন শিপমেন্টের জন্য অনুরোধ করেছি। তারা জনিয়েছেন, তারা যে কম্পোনেন্টগুলো কেনেন, সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। একটি মেশিন বানাতে ২০টির মতো আইটেম প্রয়োজন। তারা এগুলোর ম্যাটেরিয়াল জোগাড় করতে পারছেন না। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে ম্যাটেরিয়াল কিনে তারপর অ্যাসেম্বল করেন। তাই আমাদের কাছে মেশিন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছিল না।

৫০ বছরের অগ্রযাত্রায় কার অবদান সবচেয়ে বেশি? উদ্যোক্তা নাকি শ্রমিকের?

শ্রমিকের অবদান অবশ্যই রয়েছে। সবারই অবদান রয়েছে। বেসরকারি খাতে সরকারের কিছু করার নেই। আমরা পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করেছি। সরকারের তেমন কিছু করার আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে সরকারের সাপোর্ট রয়েছে। সরকারের নীতিসহায়তা আছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অর্জনে আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি কী?

করোনা পরিস্থিতিতে সারা দুনিয়া বসে গেছে। পাকিস্তানে ২০০ টাকার ওপরে ডলার। আমার মতে, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের ইকোনমি ভালো। ভারত ইদানীং আমাদের ধরার চেষ্টা করছে। তাদের তুলার নিজস্ব উৎপাদন রয়েছে। ভারত বাংলাদেশে সুতা রফতানি করতে একটা ইনসেনটিভ পায়। সেটা আগাগোড়া পেত। এখন ভারত ১১ দশমিক ৯৩ পয়সা প্রতি কেজিতে ইনসেনটিভ দিয়েছে, অ্যাডিশনাল। এটা দেয়ার কারণে ভারত থেকে ম্যাটেরিয়াল কিনে ১০ টাকা লসে বাংলাদেশে রফতানি করলেও লাভ আছে। এটা আমাদের স্পিনিংয়ের জন্য একটা ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করবে।

যদি বাংলাদেশে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ না থাকে বা ফেল করে তাহলে একটা সময় ঘটনাক্রমে ভারত থেকে সুতা আমদানি করে আমাদের রফতানি করা সম্ভব হবে না। তখন তারা বেঁকে বসবে। তখন তারা দাম বাড়াবে বা রফতানি বন্ধ করবে। আমাদের গার্মেন্ট সেক্টর এগোনোর পেছনে আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের অবদান অনেক বেশি। আমরাও গার্মেন্ট সেক্টরে আছি।

ভারত বাংলাদেশে সুতা বিক্রি করে। বাংলাদেশের স্পিনিং সেক্টরের মেশিন ভারতে ম্যানুফ্যাকচার হয়েছে। তারা সেখানে ফ্যাক্টরি বানিয়েছে। অনেকগুলো ইউরোপিয়ান কোম্পানি ভারতে টেক্সটাইল মেশিনারিজ কোম্পানি তৈরি করছে। আমাদের আমদানি করতে হয়।

আমাদের ট্যাক্সের বোঝা ও জটিলতা আছে, কাস্টমস থেকে ছাড়ানো যায় না। অনেক রকম ঝামেলা রয়েছে। ভারতীয় লোকাল স্পিনারদের ক্ষেত্রে এটা নেই। তারা বাজারে গেলে কটন কিনতে পারে। আর আমাদের আমদানি করতে হয়। আমাদের তিনটি পাইপলাইন মেইনটেইন করতে হয়, এটা ভারতীয়দের বেলায় নেই। সব মিলিয়ে ইন্ডিয়ার স্পিনিং ব্যবসায়ীদের যে রোডম্যাপ, এতে ভারতীয় সুতা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এ বছর সুতায় আমরা লাভ করেছি। যেসব মিলে তুলা কেনা ছিল, তুলার দাম বাড়ার কারণে আমাদের সুতায় লাভ হয়েছে, যার তুলা ছিল না সে এ লাভটা করতে পারেনি।

রফতানিতে ১০০ বিলিয়ন ডলারের অর্জন কি খুব দ্রুত সম্ভব হবে?

না, খুব দ্রুত না পারলেও পর্যায়ক্রমে অবশ্যই পারব। তবে গার্মেন্ট সেক্টরে আমাদের ফেলে ভারত এগিয়ে যাবে এটা আমি আশা করি না। এ বছর তুলার দাম, সুতার দাম প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেল। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমরা এগিয়ে যাব।

কিছু আইটেম রয়েছে যেটা ভ্যালু অ্যাডেড। এ আইটেমগুলো আমরা করা শুরু করেছি। আমার সুতা আছে, কাপড় আছে। আমি অনেক ক্রেতার সঙ্গে কাজ করছি। তারা বলেছে কেন আমরা তাদের জিন্সের প্যান্ট দিই না। আমি নিজে ডেনিমের গার্মেন্ট করে ফেলছি। আগামীতে শুধু সুতা বিক্রি করে বাংলাদেশে ব্যবসায় শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে পারব না। তাই এখন নিজে সুতা বানাব আর নিজের ডেনিমের গার্মেন্ট কারখানায় ব্যবহার করব।

সরকারের কিছু জিনিস অনেক ভালো। যেমন ডলার ক্রাইসিসে অনেকেই বেশি খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আমরা অতটা খারাপ অবস্থার মধ্যে নেই। প্রবাসী মানুষের কষ্টে অর্জিত যে ডলার সেটার মধ্যে একটা ইনসেনটিভ ডিক্লেয়ার করা আছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। আরেকটি হলো আমাদের এক্সপোর্ট ভলিউম এখনো আছে। এটি আমাদের কমেনি। এ কারণে আমরা ডলারে মার খাব না।

শূন্য থেকে আজকের অবস্থানে আপনি এসেছেন, নিজের পাশাপাশি দেশকেও এগিয়ে যেতে অবদান রেখেছেন। কেমন ছিল গত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা?

নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিককার কথা। নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে সুতা বাণিজ্যের গদি সামলাতাম। সুতার এজেন্ট ছিলাম। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুতা সরবরাহের কাজ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলে প্রায়ই ওভাবে ঘুমাতাম। টানবাজারে সুতার গদি থেকেই ব্যবসার শুরু। স্পিনিং মিলের এজেন্ট ছিলাম। সাধারণত স্পিনিং মিলের সঙ্গে বার্ষিক, দ্বিবার্ষিক বা ত্রিবার্ষিক চুক্তি করতাম। চুক্তি অনুযায়ী স্পিনিং মিলের উৎপাদিত সুতা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করতাম।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) হিসাব মতে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি সুতা রফতানি করেছে এমন শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম অবস্থানে আছে বাদশা টেক্সটাইলস লিমিটেড। চতুর্থ অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানটি হলো কামাল ইয়ার্ন লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানও বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের। ২০২৩ সালেও শীর্ষস্থান ধরে রাখে বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। ওই বছর সুতার রফতানিতে ১ নম্বর অবস্থানে ছিল বাদশা টেক্সটাইল। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল কামাল ইয়ার্ন।

বস্ত্র শিল্পের ব্যবসায় প্রবেশ করলেন কেন?

মাদারীপুর জেলার শিবচরের পাঁচচর ইউনিয়নে আমার জন্ম। শিবচরে বসবাস করা জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই তাঁত ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। সেই সূত্রে ১৯৭৬ সালের দিকে জীবিকার তাগিদে নারায়ণগঞ্জে আসা। ১৯৭৭ সালে সুতার পাইকারি বাণিজ্য শুরু করি। পর্যায়ক্রমে ঐতিহ্যগত সুতার গদির মালিক হই। সুতার বাণিজ্য দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও শিল্প গড়ে তুলতে গিয়ে প্রথমে স্থাপন করি রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা। ২০০০ সালে গড়ে তুলি পাইওনিয়ার সোয়েটার লিমিটেড। এরপর ২০০৪ সালে ময়মনসিংহের ভালুকায় একে একে স্থাপন করি বাদশা টেক্সটাইলস লিমিটেড ও কামাল ইয়ার্ন লিমিটেড। দেশে সুতা উৎপাদনে সবচেয়ে বড় সামর্থ্য রয়েছে এ দুই কারখানারই। এ কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক প্রায় ৩২৫ টনের বেশি। বর্তমানে বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের বার্ষিক টার্নওভার ৩০-৪০ কোটি ডলার।

দেশের শিল্পায়নের শুরুর দিকে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে বিনিয়োগ করে দেশের অন্যতম বড় একটি শিল্প গ্রুপ। তাদের টেক্সটাইল কারখানায় উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে উপদেষ্টার ভূমিকা রেখেছিলাম। নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিও নিষ্ঠা ও একাগ্রতা এখনো ধরে রেখেছি। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ ছুটির সময় প্রায় এক মাস বন্ধ ছিল শিল্প গ্রুপ বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। পরে উৎপাদন চালু হলে টানা ২০-২২ দিন কারখানায়ই পড়ে ছিলাম। লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক মহামারীতে সংকটে পড়াশিল্পোৎপাদনের গতি পুনরুদ্ধার। কাজের প্রতি একাগ্রতা থেকেই নানা সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী কারখানায় অবস্থান করা হয়। আর ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরু থেকেই এ চর্চা অব্যাহত রেখেছি। সে কারণেই টানবাজারের সুতার গদির ব্যবসায়ী থেকে এখন দেশের শীর্ষ সুতা উৎপাদনকারী কারখানার মালিক।

কভিড সংকট কীভাবে মোকাবেলা করেছেন?

কভিডকালীন সাত-আট মাসে অনেক লোকসান হয়েছে। তুলার দাম পড়ে যায় মার্চ-এপ্রিলে। তখন আমরা হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর পোশাকের ক্রয়াদেশ ফিরতে শুরু করলে পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। অবশ্য দাম পাওয়া যাচ্ছিল না তখনো। পর্যায়ক্রমে কারখানার সব মজুদ পণ্য শেষ হয়ে যায়। এ কারণে পূর্ণ সক্ষমতায় কারখানা সচল রাখা গেছে। আমাদের স্পিনিংয়ে স্পিন্ডল তিন লাখের ওপরে। পাইওনিয়ার ডেনিম বাংলাদেশে বৃহত্তম ডেনিম উৎপাদনকারী কারখানা। আমি কামলা মানুষ, এখনো কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের স্পিন্ডলপ্রতি উৎপাদন শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র ভারতের চেয়েও বেশি। ধারাবাহিকভাবে গত পাঁচ বছর প্রথম ও দ্বিতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটিও আমাদের। বাদশা টেক্সটাইলের উৎপাদন সক্ষমতা আরো বাড়ানো হচ্ছে। আমাদের কর্মী সংখ্যা বর্তমানে ২৮ হাজার।

বাদশা গ্রুপ গড়ে তুলতে ব্যাংকের সহযোগিতা কেমন পেয়েছেন?

বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানা গড়ে তুলতে ব্যাংকের অর্থায়ন নেয়া হয়েছে। আর তা নেয়া হয়েছে শুধু কারখানার মূলধনি যন্ত্র স্থাপনে। এছাড়া ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জোগানও নিশ্চিত করা হয় ব্যাংকের সহায়তায়। প্রতিষ্ঠানটিতে বড় বিনিয়োগ করেছে এমন ব্যাংকগুলোর মধ্যে আছে বহুজাতিক হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি, বাংলাদেশ), ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও আল-আরাফাহ্ ব্যাংক। শুরুর সময়টা বাণিজ্যের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবসা করা হলেও শিল্প গড়ে তুলতে মূলত সহযোগিতা নেয়া হয়েছে ব্যক্তি খাতের ব্যাংক থেকে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন