নাট্য সংগঠন

মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যচর্চা

শফিকুল ইসলাম ও আনিসুর রহমান

ছবি: মাহিদুল ইসলাম খন্দকার

দেশ ভাগের পর পাকিস্তানি চেতনার দ্বারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পধারা হলো নাটক। যদিও ভাষা আন্দোলনে ফিরে পায় নবপ্রাণ। স্বাধীনতার পর ফিরে পায় পূর্ণ যৌবন। দেশভাগ পরবর্তী মুক্তি আন্দোলন—নাটক শুধু নিছক বিনোদনের জন্য নয় বরং প্রতিবাদ, বিল্পব, বিদ্রোহের বার্তা নিয়ে নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের কথা বলেছে, হয়ে উঠেছে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। পশ্চিম পাকিস্তানিরা যখন বাংলার মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়েছিল তখন নাটকও হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের ভাষা। এসব নাটক স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি রচনায় যেমন ভূমিকা রেখেছে তেমনি জনমনে স্বাধীনতার বীজ বপন করতেও উজ্জীবিত করেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দেশ ভাগের পর মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা এবং বিভিন্ন জেলাকেন্দ্রিক নাট্যচর্চা শুরু হয়। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ফাহিম মালেকের লেখা ‘‌বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন নাট্যচর্চা’ নিবন্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাবির নাট্যচর্চার উল্লেখ রয়েছে। জানা যায়, ১৯৪৭ সালের ১৮ মার্চ কার্জন হলে মঞ্চায়িত হয় শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘‌বিন্দুর ছেলে’ ৩ এপ্রিল তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়ের ‘‌বিংশ শতাব্দী’ নাটক। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ড্রামা সার্কেল’ নাট্য সংগঠন। ১৯৬১ সালের মে মাসে যখন রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী পালনে বাধা আসে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ‘ড্রামা সার্কেল’ মঞ্চায়ন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজা ও রাণী’ নাটক। এর এক মাস পর মঞ্চায়িত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত নাটক ‘তাসের দেশ’ ও ‘রক্তকরবী’। ১৯৫৯ সালে ঢাকা ইউসিস অডিটোরিয়ামে ‘সবাই আমার ছেলে’; ১৯৬২ সালে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘বহিপীর’, ১৯৬২ সালে ঢাকা ইউসিস অডিটোরিয়ামে সাঈদ আহমদের ‘দ্য থিং’ অবলম্বনে ‘কালবেলা’সহ অনেক নাট্যপ্রযোজনা মঞ্চে আনে ‘ড্রামা সার্কেল’। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ মঞ্চস্থ করে ‘আজকাল’; ঢাবি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল মঞ্চস্থ করে আসকার ইবনে শাইখের ‘শেষ অধ্যায়’ নাটক। ১৯৭০ সালে ঢাকা শহরে মঞ্চায়িত হয় অসংখ্য নাটক। সেখানে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ’ কর্তৃক অভিনীত হয় নাটক ‘রক্তকরবী’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ’ মঞ্চস্থ করে সামাজিক নাটক ‘বিদ্রোহী পদ্মা’। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ’ মঞ্চস্থ করে সামাজিক নাটক ‘আবর্ত’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও সংগীত বিভাগের শিক্ষক নাট্যকার, নির্দেশক বিপ্লব বালার ‘‌ঢাকার মঞ্চনাটক: দর্শক-সমালোচকের মুখোমুখি ১৯৭২-১৯৯০’ নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-এর সাংস্কৃতিক বিভাগ ‘নাট্যচক্র’ ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২-এ ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে মঞ্চস্থ করে দুটি নাটক। সেলিম আল দীন রচিত এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা এবং আল-মনসুর প্রণীত রেভল্যুশন এবং খ্রিষ্টাব্দ সন্ধান।  ১৯৭২ সালে ২-১১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ আয়োজন করে আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতা। আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার একটি শর্ত ছিল প্রতিটি নাটক হতে হবে নতুন নাটক এবং ছাত্রদের দ্বারা রচিত। শিক্ষার্থীদের রচিত ও মঞ্চায়ন করা নাটকগুলো হলো—‘এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা’ ‘রেভল্যুশন এবং খ্রিস্টাব্দ সন্ধান’, ‘অস্থির সুস্থিতি’, ‘সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ’, ‘কালো অশোক লাল ফুল’, ‘পেণ্ডুলামের খুন’, ‘জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘ রোলার এবং নিহত এলএমজি’, ‘উন্মোচন’, ‘দাঁড়াবো শুধুই’, ‘রংহীন সিগন্যাল’, ‘দানব’, ‘চাবির দুঃখ’, ‘করিম বাওয়ালীর শত্রু’, ‘মূল মুখ দেখা’, ‘ম্যাসাকার’, ‘সংবাদ শেষাংশ’, ‘উৎস থেকে সমুদ্দুর’ এবং ‘কিংশুক যে মরুতে’। জগন্নাথ হল, জহুরুল হক হল, মুহসীন হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, রোকেয়া হল, শহীদুল্লাহ হল, শামসুন্নাহার হল ছাত্র সংসদের প্রযোজনায় ১৯৭২ সালে নাটকগুলো আবাসিক হলে মঞ্চায়ন হয়। 

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যে নবনাট্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তার প্রাণকেন্দ্র ছিল টিএসসি। একে কেন্দ্র করেই গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের প্রাথমিক সূচনা। নাট্যশিক্ষাঙ্গন প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন নাটক দলের মহড়া হতো এ টিএসসিতে। এখানে নাট্যকর্মীদের নিয়মিত আড্ডা-কোলাহল, নাট্য কর্মশালা এবং মহড়া হতো। পূর্বে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সে রকম উপস্থিতি না থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি অনুরাগীরা বিভিন্ন দলগুলোকে কেন্দ্র করে কার্যক্রম পরিচালিত করত। বিভিন্ন দলের নতুন সদস্য সংগ্রহের বক্স থাকত টিএসসির সামনে। যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কর্মশালার সুযোগ পেত। হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য সন্ধ্যা বেলার কর্মশালা এবং মহড়ায় অংশগ্রহণ ছিল সহজ। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তৎকালীন নাটকে মুক্তিযুদ্ধের ভাবধারা তুলে ধরা হতো। সমাজসচেতন নাটক যেখানে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি ছিল এসব নাটকে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার জন্য এ নাটকের সূচনা, সেটা হোক মঞ্চে কিংবা পথ নাটকে।

৭৫-এর পরবর্তী পর্যায়ে দেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার আবহ ফুটে ওঠে মঞ্চ নাটকে। এ নাট্য আন্দোলনে সংস্কৃতিকর্মীরা স্বৈরাচারবিরোধী, সামরিক শাসনবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপসহীন ভূমিকা পালন করেছে। টিএসসিকেন্দ্রিক নাট্য দলগুলোর দু’য়েকটি বাদে প্রায় সবাই এখানে যুক্ত ছিল।

নব্বইয়ের পর নাট্যকলা চর্চা অবহেলিত হয়ে পড়ে। কমে আসে সামাজিক প্রেক্ষাপটে নাটকের মাধ্যমে প্রতিবাদ চর্চা। সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবেশ দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সংস্কৃতিকর্মীরা। 

যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে নাট্যচর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। ১৯৯৪ সালে নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের যাত্রা শুরু হয়, যা ২০০৯ সালে থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ নামে স্বতন্ত্রভাবে যাত্রা শুরু করে। এই বিভাগের পরিবেশনা ও ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় বার্ষিক নাট্যোৎসব’ উদযাপিত হয়। শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় ২০১৬ সালে ‘মঞ্চ হোক মুক্তির পথ’ স্লোগান সামনে রেখে গড়ে ওঠে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য সংসদ’। এছাড়া ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক সংসদ’ এবং ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ পৃথকভাবে নাট্যচর্চা করছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন