২০২২-২৩ অর্থবছর

ডিজেল থেকে সর্বোচ্চ শুল্ক আদায়

হাফিজুর রহমান

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) মোট ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে আমদানি-রফতানি পর্যায়ে শুল্ক হিসেবে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। যদিও অর্থবছর শেষে শুল্ক আহরণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৭৩২ কোটি টাকায়। লক্ষ্যের তুলনায় ঘাটতি থেকে গেছে ১৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। এনবিআরের শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পণ্য আমদানি-রফতানি পর্যায়ে গত বছর সবচেয়ে বেশি শুল্ক আহরণ হয়েছে হাই স্পিড ডিজেল থেকে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি শুল্ক আদায় হয়েছিল ফার্নেস অয়েল থেকে।

হাই স্পিড ডিজেল ছাড়াও গত অর্থবছরে শুল্ক আহরণের দিক থেকে শীর্ষে থাকা অন্যান্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে চিনি, ফার্নেস অয়েল, সিমেন্ট ক্লিংকার, পাথর, প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড স্টিল শিট, কয়লা, বিটুমিন, কমলা ও আপেল। শীর্ষ ১০ পণ্য থেকে গত অর্থবছর এনবিআর শুল্ক আদায় করেছে ২৬ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে এ তালিকার ১০ পণ্য থেকে আহরণ হয়েছিল ২৪ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা।

বাণিজ্য খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ডলার সংকট, বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা ও এলসি খোলায় কড়াকড়ির মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে গত অর্থবছরে পণ্য আমদানি-রফতানি থেকে লক্ষ্যমাফিক শুল্ক আহরণ করা যায়নি। পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন তারা। 

২০২১-২২ অর্থবছরে এনবিআরের শুল্ক আহরণে ঘাটতি ছিল ৬ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছর তা আরো বেড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক হিসেবে দেখছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন সামনের দিনগুলোয়ও যদি শুল্ক আহরণে ঘাটতির হার সম্প্রসারিত হতে থাকে, তাহলে তা গোটা রাজস্ব ব্যবস্থায় চাপ বাড়াবে। একই সঙ্গে হয়ে উঠবে সরকারের ঋণনির্ভরতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। 

এনবিআরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছর হাই স্পিড ডিজেল আমদানি হয়েছে ৪৫ লাখ ৭৭ হাজার ৭৫২ টন। এতে শুল্ক আহরণ হয়েছে ৬ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা, এর আগের অর্থবছর হয়েছিল ৩ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। এ পণ্যে শুল্ক আহরণ বেড়েছে ৭৮ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছর সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা শুল্ক আহরণকারী পণ্য ফার্নেস অয়েল থেকে এবার আয় হয়েছে ৪ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। 

ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েল, ডিজেল ও অকটেনের মতো প্রধান জ্বালানি তেল থেকে সরকার আগে ১০ শতাংশ শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ও ৫ শতাংশ অগ্রিম কর আয় করত। দেশে অব্যাহত মূল্যস্ফীতির কারণে চলতি অর্থবছর থেকে মোট ১৩ ধরনের জ্বালানি পণ্যে ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা সুনির্দিষ্ট শুল্ক বেঁধে দেয়া হয়েছে। 

দেশে সরকারি পর্যায়ে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলসহ অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি করে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এর বাইরে বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি কোম্পানিও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে বিপুল পরিমাণ ফার্নেস অয়েল আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পণ্য আমদানির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে (সংশোধিত হিসাব) ৭৯৯ কোটি ৩১ লাখ ডলারের জ্বালানি তেল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল এসেছে ৯৩ কোটি ৫৯ লাখ ডলারের এবং পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়েছে ৭০৫ কোটি ৭২ লাখ ডলারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জ্বালানি পণ্য আমদানিতে ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে ৫৭৭ কোটি ২৮ লাখ ডলারে। এর মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬২ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের। পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৫১৪ কোটি ৫২ লাখ ডলারের। সে হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানি কমেছে ২৭ শতাংশ। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্বালানি খাতের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডলার সংকট না হলে জ্বালানি তেল, বিশেষ করে ফার্নেস অয়েল আমদানি আরো বেশি হতো। এনবিআর আরো অনেক বেশি আমদানি শুল্ক পেত। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে গত অর্থবছর জ্বালানি তেল আমদানির পরিমাণ অনেক কমেছে।’ 

আমদানি পর্যায়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শুল্ক আদায় হয়েছে চিনি থেকে। গত অর্থবছর এ পণ্য থেকে ৪ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা শুল্ক এসেছে। যদিও ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৮৭২ টন চিনি কম আসায় ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১৭০ কোটি টাকা কম শুল্ক আদায় হয়েছে। সিমেন্ট ক্লিংকার থেকে শুল্ক আহরণ হয়েছে ৩ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা, যা এর আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ৩১৫ কোটি টাকা বেশি। তবে ১ লাখ ৯৯ হাজার ১২৯ টন ক্লিংকার কম আমদানি হয়েছে গত অর্থবছর।

এ বিষয়ে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সংকটময় পরিস্থিতিতেও নির্মাণ খাতের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সিমেন্ট উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে এ খাতের উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির চেষ্টা করে গেছেন। আমরা কারখানা সম্প্রসারণের কাজও করেছি। উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ২৫ হাজার টনে উন্নীতের পদক্ষেপ নিয়েছি। ফলে শিল্পের এ কাঁচামালের আমদানি আরো বাড়বে। আর আমদানির সঙ্গে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির বিষয়টি সরাসরি জড়িত। ঋণপত্র খোলায় বাধাগ্রস্ত না হলে এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় আরো বাড়বে।’ 

পাথর আমদানিতে গত অর্থবছর শুল্ক আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭২ শতাংশ। নির্মাণ খাতের এ পণ্যটি থেকে মোট শুল্ক আহরণ হয়েছে ১ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা, যা এর আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭৫১ কোটি টাকা বেশি। প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড স্টিল শিট ১ লাখ ২৭ হাজার ২২০ টন কম আমদানি হওয়ায় পণ্যটি থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর সরকারের শুল্ক আহরণ হয়েছে ১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছর এসেছিল ১ হাজার ৬০১ কোটি টাকার শুল্ক।

দেশে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ায় গত অর্থবছর আগের অর্থবছরের চেয়ে ৯ লাখ ৬২ হাজার ২৩৯ টন বেশি কয়লা আমদানি হয়েছে। ফলে জীবাশ্ম জ্বালানি পণ্যটি থেকে শুল্ক আদায় হয়েছে ১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা, যা এর আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৪৬ কোটি টাকা বেশি। বিটুমিন আমদানি ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৯৩ টন কম আমদানি হয়েছে গত অর্থবছর। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ২৮৮ কোটি টাকা বেশি শুল্ক আহরণ হয়েছে। গত অর্থবছর এ পণ্য থেকে শুল্ক আহরণের পরিমাণ ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা।

খাদ্যপণ্য কমলা ও আপেল আমদানি থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর শুল্ক আহরণ হয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ১১২ কোটি ও ৯৯২ কোটি টাকা। তবে ৭৪ হাজার ৬৬২ কোটি টন কমলা কম আমদানি হয়েছে। আবার আমদানি কমলেও শুল্ক আহরণ বেড়েছে ১৪১ কোটি টাকা। আপেল আমদানিতে অবশ্য শুল্ক আহরণ কমেছে ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ৭৭৮ কোটি টাকা। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ফল আমদানিকারক ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আপেল ও কমলার মতো ফলগুলো আমদানিতে ভালো শুল্ক আহরণ হয় সরকারের। তবে এখন এসব বিদেশী ফলের আমদানি বেশ কমে এসেছে। শতভাগ মার্জিনে এলসি খোলার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন একটি বড় কারণ। এছাড়া স্থানীয় বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদেশী এসব ফলের চাহিদাও বেশ কমে এসেছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন