লক্ষ্মীপুরে সজীব হত্যাকাণ্ড

পুলিশের দাবি অরাজনৈতিক হত্যা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে খুন বলছেন আ.লীগ

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, লক্ষ্মীপুর

ছবি : বণিক বার্তা

লক্ষ্মীপুরে বিএনপির পদযাত্রায় এসে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত সজিবকে নিয়ে পাল্টা-পাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন পুলিশ, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। পুলিশ বলছে, নিহত সজীব বিএনপির পদযাত্রায় এসে মারা যাননি, ব্যক্তিগত কাজে এসে দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। নিহত সজিব বিএনপির কর্মী নন। তবে নিহতের পরিবারও বলছেন, সজীব পদযাত্রায় গিয়েই খুন হয়েছেন। 

এদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, নিজেদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে সজিব খুন হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের উপর দোষ চাপাচ্ছে বিএনপি। তারা দাবি করে বলছেন, উত্তর তেমুহনী এলাকায় শান্তি সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। কলেজ রোড এলাকায় তাদের কোনো নেতাকর্মী ছিলেন না। অন্যদিকে জেলা বিএনপি বলছে, ছাত্রলীগ নেতারাই সজীবকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। সে কৃষকদলের একজন সক্রিয় কর্মী। তারা এও বলছেন, ঘটনার সময় ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী বিএনপির পদযাত্রায় অংশ নেয়া কিছু নেতাকর্মীদের অস্ত্রহাতে ধাওয়া করে। পরে পরিকল্পিতভাবে তাকে ছুরিকাঘাত করে তারা।  

এদিকে ঘটনাস্থলের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সজীব নামের এক যুবক রক্তমাখা দেহ নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। সে শহরের কলেজ রোড সংলগ্ন মদিন উল্যা হাউজিং এর পাশের ফিরোজা টাওয়ার নামে একটি ভবনে আশ্রয় নেয়। দৌড়ে ভবনের দ্বিতীয় তলাতে উঠে পড়ে সে। কিছুক্ষণ পর সেখানে জনৈক এক লোক দরজা খুলে তার হাতে কাপড় বাঁধে দেয়। তবে ওই ভবনের বাসিন্দারা জানান, পুলিশকে ফোন করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আসেনি পুলিশ।

স্থানীয়রা বলছে, কলেজ রোডে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় রক্তাক্ত এক যুবককে মদিনা উল্যার হাউজিং এর ভেতরের দিকে ছুটতে দেখা যায়। দুই রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষের কবলে পড়ে সে আহত হয়েছে বলে জানায় তারা।

এদিকে সজীব হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন লক্ষ্মীপুরের রাজনৈতিক মাঠে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল একে অপরকে নিয়ে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছেন। আর হত্যাকাণ্ডকে অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে দাবি করছে পুলিশ। যদিও নিহতের পরিবারও বলছেন, সজীব পদযাত্রায় গিয়েই খুন হয়েছেন। সংঘর্ষ এবং মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে পুলিশ, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পক্ষ থেকে পৃথক সময়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। একটি ঘটনা নিয়ে পৃথক তিন সংবাদ সম্মেলনে তিন রকম বক্তব্য উঠে আসে। তবে হত্যাকাণ্ড নিয়ে স্থানীয়দের বক্তব্যের সাথে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়নি। 

পুলিশ সুপার মাহফুজ্জামান আশরাফ নিজ কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিং এ বলেন, বিএনপি পদযাত্রাটি শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানির গো-হাটা সড়কের বাসভবন থেকে শুরু করে দক্ষিণ তেমুহনী হয়ে আধুনিক হাসপাতালের সামনে এসে শেষ করার কথা ছিল। তারা লাঠি বহন করবে না, উগ্র আচরণ করবে না, শান্তিপূর্ণভাবে প্রোগ্রাম শেষ করবে। আমাদের এমন আশ্বাস দেয়ায় আমরা অনুমতি দিয়েছি। কিন্তু তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঝুমুরের দিকে হাইওয়ে সড়কে উঠার চেষ্টা করে। পুলিশ তাদের বাধা দিয়েছে, উত্তেজিত জনতা লাঠি ও ইটপাটকেল নিয়ে পুলিশের উপর আক্রমণ করে। তাদের নিবৃত্ত করতে পুলিশ লাঠিপেটা, টিয়ারশেল, কাঁদানেগ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে। সংঘর্ষের সূত্রপাতের জন্য এসপি বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিকে দায়ী করেন।

এ সময় পুলিশ সুপার বলেন, মরদেহ উদ্ধারের স্থান থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সজিব আহত অবস্থায় ফিরোজা ভবন নামের একটি বাসায় ঢুকে পড়ে। মৃত্যুর আগে সেখানকার এক জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে সজিবের কথা উল্লেখ করে পুলিশ সুপার বলেন, সে বিএনপির প্রোগ্রামে আসেনি। ৪-৫ জন লোক তাকে কুপিয়েছে। তার কাছে তারা টাকা পায়। এরপর সজিব আর কোনো কথা বলতে পারেনি বলে জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা ।

এদিকে পুলিশ সুপারের দেওয়া বক্তব্যকে 'মিথ্যাচার' বলছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। তিনি দুপুরে তার বাসভবন প্রাঙ্গণে নিহত সজিবের গায়েবানা জানাযার সময় বলেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সজিবকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এর নেতৃত্বে ছিল সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এসপি এখন বলছেন, সজিব হত্যাকাণ্ড অরাজনৈতিক। এতে বুঝা যাচ্ছে, কতিপয় পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী ছাত্রলীগকে সহযোগিতা করেছে। এ খুনের সঙ্গে জড়িত সকলের তথ্য আমরা সংগ্রহ করছি। এ ঘটনায় মামলা হবে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকলকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান তিনি।

তিনি বলেন, এসপি সাহেব লক্ষ্মীপুরকে আর রক্তাক্ত করবেন না। বিএনপি নেতাকর্মীরা আজ রুখে দাঁড়িয়েছে। আমরা জেগে উঠেছি। আমাদের ২০০ থেকে ২৫০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এরমধ্যে ৪-৫ জন আহত আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। এরমধ্যে শুনেছি পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধে ৩ টি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোন মামলা-হামলার কাছে আমরা মাথা নত করি না। যতদিন পর্যন্ত এ অবৈধ সরকার পদত্যাগ না করবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।

এদিকে বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে জেলা আওয়ামী লীগ। এ সময় নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন এমপি বলেন, আমাদের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমারা শান্তি সমাবেশ করি। মঙ্গলবার বিকেলে আমাদের নেতাকর্মীরা শহরের বাজার সড়কের চকবাজার এলাকায় ছিল। সেখানে মিছিল নিয়ে উত্তর তেমুহনীতে আসে। কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা এ্যানি চৌধুরী বাসভবনে থেকে শুরু করে শহরের ব্রিজের দক্ষিণ হয়ে দক্ষিণ তেমুহনীর ঘুরে ঝুমুরের দিকে যায়। তাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের কোন সংঘর্ষ হয়নি বলে দাবি তাঁর। তিনি বলেন, সজীব বিএনপি কর্মী নয়।

আবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু বলেন, বিএনপির দু-পক্ষের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে সজিব নিহত হয়েছেন। সেখানে আমাদের কোনো নেতাকর্মী ছিল না। বিএনপি লাশের রাজনীতি বিশ্বাস করে বলেই, সজিব হত্যার দায় এখন আমাদের ঘাড়ের ওপর চাপাচ্ছে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন