চলতি অর্থবছর অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে জ্বালানির দাম ও প্রাপ্যতা

বদরুল আলম ও আবু তাহের

দেশের অর্থনীতিতে ২০২২-২৩ অর্থবছর ছিল চ্যালেঞ্জিং। কভিড সংকট কাটিয়ে অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, তখন শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত। এতে পণ্য রফতানিতে প্রতিবন্ধকতা, উৎপাদন সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতাসহ নানা ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। আর এসবের পেছনে জ্বালানি সরবরাহ সংকট এবং ঘন ঘন মূল্যবৃদ্ধিকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

চলতি অর্থবছরে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে শিল্পের উৎপাদন যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি বাড়ে পণ্যের উৎপাদন খরচ। গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির দাবিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক হয় শিল্প মালিকদের। যদিও সমস্যার সমাধান হয়নি এখনো। একই সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও উৎপাদন সংকটে পড়ে। এতে লোডশেডিংসহ ব্ল্যাকআউটের মতো ঘটনাও ঘটে।

চলতি অর্থবছরের মাঝামাঝিতে দেশের সব শ্রেণীর গ্রাহকের গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষত স্পট মার্কেটে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) মূল্যবৃদ্ধি, স্থানীয় জ্বালানি খাতে কোম্পানিগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সে সময় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। সরকারি ও বেসরকারি ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম সর্বনিম্ন ৮৭ থেকে সর্বোচ্চ ৪৯৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিইআরসির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের মাঝামাঝিতে সরকারি ও বেসরকারি ক্যাপটিভ বিদ্যুতের দাম ঘনমিটারপ্রতি ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বেড়ে বর্তমানে ৩০ টাকা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির হার ৪৯৭ শতাংশ। শিল্প খাতের ব্যবহৃত বিদ্যুতের (ক্যাপটিভ) দাম বেড়ে ১৬ থেকে ৩০ টাকা হয়। প্রতি ঘনমিটারে বাড়ে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হয়। এ দুই শ্রেণীর গ্যাসের দাম ঘনমিটারপ্রতি বাড়ে ১৫০ দশমিক ৪১ শতাংশ। এছাড়া ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বেড়ে হয় ৩০ টাকা। ঘনমিটারপ্রতি মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ১৭৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।

এদিকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলতি অর্থবছরে তিন দফা বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। বিতরণ কোম্পানিগুলোর মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে তিন দফা খুচরা পর্যায়ে মোট ১৫ শতাংশ এবং এক দফা পাইকারিতে ২২ শতাংশ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়।

গ্যাসের দাম বাড়িয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাস স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে পারেনি জ্বালানি বিভাগ। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে গত বছরের আগস্টে এলএনজির দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ৭০ ডলার উঠে গেলে চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত এলএনজি আমদানি করা যায়নি। গ্যাস সংকটে সিএনজি ও শিল্পে রেশনিং করে কয়েক মাস ধরে গ্যাস সরবরাহ করে। 

এতে লাইফলাইন গ্রাহকের (০-৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী) বিদ্যুতের দাম বাড়ে ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থবছরের শুরুতে এ শ্রেণীর গ্রাহকের ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ছিল ৩ টাকা ৭৫ পয়সা। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৩৫ পয়সায়। এতে ইউনিটপ্রতি বেড়েছে ৬০ পয়সা। কৃষিকাজে ব্যবহৃত সেচ পাম্পের বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ১৬ পয়সা থেকে বেড়ে ৪ টাকা ৮২ পয়সা (বৃদ্ধির হার ১৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ), ক্ষুদ্র শিল্পের বিদ্যুতের দাম ৮ টাকা ৫৩ পয়সা থেকে বেড়ে ৯ টাকা ৮৮ পয়সা (বৃদ্ধির হার ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ), বাণিজ্যিক ও অফিসের বিদ্যুতের দাম ১০ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বেড়ে ১১ টাকা ৯৩ পয়সা (বৃদ্ধির হার ১৫ দশমিক ৮২), নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম ১২ টাকা থেকে বেড়ে ইউনিটপ্রতি ১৩ টাকা ৮৯ পয়সা (বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ) হয়েছে। 

বিদ্যুৎ খাতে লোকসানের কথা জানিয়ে এ অর্থবছরে বিইআরসি আইন সংশোধন করে সরকার নিজেই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা নিয়ে নেয়। এ ক্ষমতাবলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় গত পাঁচ মাসে এক দফা গ্যাসের দাম এবং তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ায়।

বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের পণ্যমূল্যে এর প্রভাব পড়ে। বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, বিদ্যুতের দাম আগের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়ার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এতে বাজারের বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দামও বাড়ে কয়েক গুণ। ভোক্তা থেকে শুরু করে খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, জনজীবনে এ বাড়তি ব্যয় বহন কঠিন হয়েছে।

অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে জ্বালানির দাম সবকিছুকে প্রভাবিত করেছে। ব্যক্তি, হাউজহোল্ড, ব্যবসা, কৃষি সব খাতেই জ্বালানির দামের প্রভাব পড়ে। জ্বালানির মূল্যই মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়েছে। প্রথমত আমদানি করা, তারপর এখানে আসার পর দাম বাড়ানো হচ্ছে দফায় দফায়। 

বহিঃস্থ কারণে শুরু কিন্তু অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে বারবার বাড়ানোর ফলে এটা মূল্যস্ফীতির চাপকে আরো বাড়িয়েছে। প্রাপ্যতা সংকট সবসময়ই সমস্যা ছিল, এখন তা আরো বেড়েছে। অবশ্যই গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে সমস্যা বেশি ছিল। এটা নীতিনির্ধারণী ব্যর্থতা। 

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের যদি জ্বালানি কেনার ওপর নির্ভরশীলতা না থাকত তাহলে সংকট এত ভোগাতে পারত না। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে উত্তোলন, উদ্ভাবনের দিকে আমরা নজর দিইনি। পাশাপাশি যেটা উৎপাদন হয়েছে কিন্তু গ্রিডে যাচ্ছে না অর্থাৎ বণ্টন ব্যবস্থা ঠিক করার দিকেও মনোযোগ ছিল না। আমরা যে কিনব সেখানেও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। জ্বালানিভিত্তিক কার্যক্রমগুলো বন্ধ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার চাপের কারণে। জ্বালানির পুরো সরবরাহ চেইনে একক কোম্পানি হিসেবে বিপিসির একচেটিয়া কার্যক্রমটাও একটা সমস্যা।’

আগামীতে পরিস্থিতি সহনীয় করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগ যদি আজ করা হয় এর ফল আজকেই পাওয়া যায় না। বিনিয়োগ করার জন্য প্রথমে বাজেটে বরাদ্দ রাখার প্রয়োজন। যেমন উত্তোলনের জন্য গ্যাসক্ষেত্র খননে বাজেটে বরাদ্দ। তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে হবে।’

দেশের বিদ্যুৎ ও শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত জ্বালানির বড় একটি অংশ আমদানি করা হয়। গ্যাস হিসেবে এলএনজি এবং জ্বালানি তেল হিসেবে আমদানি হয় ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও অকটেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট শুরু হলে জুনে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত এবং পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম সে সময় ১২৬-১২৮ ডলার পর্যন্ত উঠে যায়। দেশে জ্বালানি আমদানি ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান জ্বালানি তেলে লোকসানের কথা জানালে জ্বালানি বিভাগ ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রলের দাম এক দফা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। বিশেষত চলতি বছরের শুরুতে ডিজেলের দাম ৮০ থেকে ১১৪ টাকা করা হয়। যদিও পরে এক দফা কমিয়ে তা ১০৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া পেট্রলের দাম ৮৬ থেকে ১২৫ টাকা ও অকটেনের দাম ৮৯ থেকে বাড়িয়ে ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এতে লিটারপ্রতি যথাক্রমে ৩৪ টাকা, ৩৯ টাকা ও ৪১ টাকা বাড়ানো হয়। এছাড়া ফার্নেস অয়েলের দাম লিটারপ্রতি গত এক অর্থবছরে কয়েক দফা বাড়ানো-কমানো হলেও বর্তমানে তা ৮০ টাকা লিটার বিক্রি করছে বিপিসি।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে একদিকে যেমন ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে, অন্যদিকে ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে গণপরিবহন, সেচকাজ ও ফসল উৎপাদনে খরচ বাড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে ফার্নেস অয়েলের দাম বেশি থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দেয়। এতে বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে বাড়ে লোডশেডিং। গ্রীষ্ম, সেচ ও রমজানে দুই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুতের ঘাটতি তৈরি হয়। 

গত ডিসেম্বরে দেশের শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চলে গ্যাসের সংকট বাড়ে। এ পরিস্থিতিতে এখনো খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। গ্যাস সংকটে টানা ছয় মাস ধরে উৎপাদন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে পারেনি অনেক শিল্প-কারখানা। গ্যাসের সমস্যার কারণে কারখানা লে-অফের (সাময়িকভাবে উৎপাদন বন্ধ থাকার দরুন শ্রমিকদের কর্ম অব্যাহতি) মতো উদ্যোগও নেয় সংশ্লিষ্ট শিল্প মালিকরা।

গ্যাস সংকটে বস্ত্র, সিরামিক, টাইলস থেকে শুরু করে সব ধরনের ভারী শিল্পে এর প্রভাব পড়ে। এছাড়া স্যানিটারিওয়্যার, টেবিলওয়্যার, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত ও পশুখাদ্য উৎপাদনকারীর মতো শিল্পে এর প্রভাব পড়ে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্যাসের স্বল্প চাপের কারণে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ব্যবসায়িকভাবেও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

বস্ত্র শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, জ্বালানি সংকটে কারখানায় উৎপাদন বন্ধের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত জেনারেটর বন্ধ হয়ে পুরো কারখানা ও সংলগ্ন আবাসিক এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে এ অর্থবছরে। যার প্রভাব ছিল বহুমুখী। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক খরচ ব্যাংকঋণের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণের মাধ্যমে চালানো সম্ভব নয় বলে লে-অফের কথা ভাবতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের।

সিরামিক শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, সিরামিক পণ্য উৎপাদনের জন্য কারখানায় ব্যবহৃত চুল্লিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে নির্দিষ্ট উচ্চতাপমাত্রা ধরে রাখতে হয়, যার জন্য গ্যাসের নির্দিষ্ট চাপের প্রয়োজন হয়। একবার বন্ধ হলে চুল্লিতে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা তুলতে সময় লাগে দুদিনের বেশি। কিন্তু প্রতিদিন গ্যাসের চাপ শূন্যে নেমে আসায় কারখানাগুলোয় উৎপাদন এখন এক প্রকার বন্ধ রাখতে হচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রক্রিয়াধীন অনেক সিরামিক পণ্য।

সরজমিন তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, শিল্প এলাকাগুলোয় অনেক কারখানায় দিনের বেলা গ্যাসের লাইন চালু থাকলেও প্রেসার কম থাকায় ঠিকমতো উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে পারছে না মিল কর্তৃপক্ষ। আগে গ্যাসের চাপ কম থাকলে বিকল্প বিদ্যুৎ বা ডিজেলচালিত জেনারেটরের মাধ্যমে কোনো কোনো কারখানা উৎপাদন চালু রাখতে পারত। কিন্তু এখন ডিজেলসহ সব ধরনের জ্বালানির দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটা শতভাগ সঠিক যে চলমান অর্থবছরে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে জ্বালানির দাম ও প্রাপ্যতার অনিশ্চয়তা। ২০২২ সালের জুন থেকে শুরু করে ২০২৩ পর্যন্ত নয় মাসের মধ্যে গ্যাসের দাম একবার ৯ টাকা থেকে ১৬ টাকা। আবার ১৬ টাকা থেকে ৩০ টাকা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ২০০ শতাংশ বেড়েছে। দ্বিতীয় বিষয় হলো গত বছরের শেষার্ধ থেকে শুরু করে এ বছর পুরোটাই গ্যাসের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। চড়া মূল্যের এলএনজিও নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। এতে উৎপাদন কমেছে, মেশিনারিগুলো এফিশিয়েন্সি হারিয়েছে। গ্যাসের চাপ যখন ওঠানামা করে তখন টারবাইন ইঞ্জিনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব মিলিয়ে চলমান অর্থবছরে অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি ঘটিয়েছে জ্বালানি খাত। আর ডলার সংকটের মূল কারণ হলো আমদানীকৃত জ্বালানি। গত অর্থবছরে জ্বালানি আনা হয়েছে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারের। চলমান অর্থবছরে এটা গিয়ে দাঁড়াবে ১০ বিলিয়ন ডলারে। কেনা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে। বিক্রি হচ্ছে স্থানীয় মুদ্রায়। এটাও ক্ষতিসাধন করেছে। আজকে আমাদের নিজস্ব জ্বালানি থাকত তাহলে রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার বেশি থাকত। আমাদের কূপগুলো খনন না করে যদি শুধু রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকভাবে করত তাহলেও গ্যাস কমত না। আমাদের নিজস্ব জ্বালানির উৎস খুঁজিনি। আমরা কয়লা করছি সেখানেও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। একদিকে নীতিনির্ধারকরা পরিকল্পনা করছেন ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির, অন্যদিকে শিল্পের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন, রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার ছোট করছেন, জুলাই থেকে সুদের হার হবে দুই অংকের, গ্যাসের সরবরাহ অপ্রতুল, মূল্য দ্বিগুণ হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে শিল্পের জন্য সব ধরনের বৈরী সিদ্ধান্ত নিয়ে ১০০ বিলিয়ন ডলারের জার্নি কীভাবে আশা করতে পারেন, সেই প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে।’

সরকারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান অর্থবছরে জ্বালানির দাম ও প্রাপ্যতা সমস্যার মূলে ছিল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট। সেই সংকটের প্রভাব উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পর্যায়েও পরিলক্ষিত হয়েছে। এ কারণে শিল্প খাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম ও সরবরাহে কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যার মূলে জ্বালানি ছিল, এমনটা মানতে নারাজ তারা। 

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্প খাত যে উচ্চ পর্যায়ে আছে সেটার পেছনে মূল অবদান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের। একসময় বিদ্যুতের অভাবে শিল্প হয়নি। অর্থনীতি ভঙ্গুর ছিল, স্থবির ছিল। বিদ্যুতের অভাবনীয় সাফল্যের কারণে শিল্প বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছে। দুই বছর ধরে যেটা চলছে সেটা বৈশ্বিক সংকট। এ সংকটের ঢেউ বিশ্বের উন্নত দেশেও লেগেছিল, আমাদের এখানেও লেগেছে। এ কারণে শিল্প খাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে বটে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে একমাত্র দায়ী সেটা বলা যাবে না। প্রথম দায়ী হবে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে। যদি জ্বালানি পেতাম তবে চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হতো। অবশ্যই বৈশ্বিক সংকটের ফলে সার্বিকভাবে অর্থনীতি শিল্প প্রসার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও জ্বালানি খাতে প্রভাব পড়েছে। আর দামের ক্ষেত্রে বলতে হবে চাহিদা-সরবরাহ-দাম এগুলো একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমার যদি চাহিদা বেশি থাকে, সাপ্লাই যদি কম থাকে তাহলে দাম বাড়বে এবং সেটাই হয়েছে। শুধু যে ডলারের প্রাপ্যতা বিষয় ছিল তা না আমাদের পিডিবির প্রাথমিক জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় আমাদের যেখানে ভর্তুকি হতো ১৫ হাজার কোটি টাকা, সেটা ৪০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। সেখানেও একটা সংকটে আমরা পড়েছিলাম। অবশ্যই দাম একটা ফ্যাক্টর ছিল।’ 

এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর জ্বালানি প্রাপ্যতা কমে গেছে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়েছে, যার ফলে সরকারকে দাম বাড়াতে হয়েছে। আমাদের ক্রুড অয়েল বিশ্ববাজার থেকে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। বেশি দামে বিক্রি হওয়ার ফলে ভোক্তা পর্যায়ে দুর্ভোগ বেড়েছে। সব মিলিয়ে জ্বালানি প্রাপ্যতা এবং মূল্যবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে। জ্বালানির দাম ও প্রাপ্যতা সংকট মোকাবেলায় আগামী অর্থবছরে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা জোরালো করাসহ সঠিক দামে আমদানির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় ডলারের সরবরাহ ঠিক রাখার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এভাবে যদি এলএনজি, অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে পারি তাহলে জ্বালানি প্রাপ্যতা ঠিক থাকবে। আবার এগুলোর ওপর যেসব ভ্যাট আছে সেগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। জ্বালানির মতো মৌলিক পণ্যে সরকারের ব্যবসা করার নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এভাবে ভোক্তা পর্যায়ে সহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন