রিভিউ

নীরবতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে ‘‌চিৎকার’

মাহমুদুর রহমান

দাহাড়ের দৃশ্যে সোনাক্ষী সিনহা ছবি: প্রাইম ভিডিও

সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে সোনাক্ষী সিনহা অভিনীত সিরিজ দাহাড়। শব্দটির অর্থ ‘‌চিৎকার’। কিন্তু রিমা কাগতি পরিচালিত এ সিরিজে কোনো চিৎকার চেঁচামেচি নেই, যা আছে, তা গুম ধরা নৈঃশব্দ্য। রাজস্থানের অবস্থা ও তার নানা রূপ নিয়ে সিরিজের গল্প। বিশেষত সেখানে এসেছে নারীদের প্রতি সহিংসতা ও এক সাইকোপ্যাথের গল্প। একের পর এক খুন করে যাওয়া সে সাইকোপ্যাথ কেন ও কীভাবে হত্যা করে যায় সে গল্প বলে দাহাড়। আর এর মধ্যেই একটু একটু করে আসে সেখানকার সমাজে প্রচলিত নানা বিশ্বাস, সংস্কার ও মানুষের সুযোগ সন্ধানী মনোভাব। এ সিরিজে হত্যাকে কেন্দ্র করে থ্রিল তৈরির তুলনায় একটি সমস্যাকে চিহ্নিত করার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে।

সিরিজের শুরুতেই একটি হারানো মেয়ের খবর পাওয়া যায়। তার কেসটি পুলিশ নিতে চায় না। অন্যদিকে মেয়েটির ভাই এ সময় স্থানীয় নেতার অ্যাকটিভিজম দেখে একটি ফন্দি বের করে। সে জানায় মেয়েটি একটি মুসলিম ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে। নেতা এ বিষয় ধরে পুলিশকে চাপ দিয়ে কেস নেয়ার ব্যবস্থা করে। সিরিজের গল্পে এ পর্যায়ে ভারতের স্থানীয় রাজনীতির একটি ছাপ পাওয়া যায়। সেখানে ইচ্ছাকৃত নানা সমস্যা সৃষ্টি ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কেস সাজানোর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। স্থানীয় সে নেতা আরেকটি মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবরের সূত্র ধরে একটি মুসলিম ছেলেকে রেললাইনে বেঁধে রাখে মরার জন্য।

দাহাড় নানাভাবেই ভারতের মফস্বল বা ছোট শহেরে ঘটতে থাকা এ রকম নানা ভুল বিষয়ের খবর আমাদের সামনে তুলে ধরে। ইন্সপেক্টর অঞ্জলী একজন পুলিশ অফিসার হওয়া সত্ত্বেও নানা কারণে প্রতিকূল অবস্থার শিকার হয়। প্রথমত, সে নারী। দ্বিতীয়ত, নিচু জাতের। সিরিজের কয়েকটি পর্বেই দেখানো হয়েছে স্থানীয় ‘ছোকড়া’রা অঞ্জলীকে বিরক্ত করে। সোজা ভাষায়, টিজ করে। এর কারণ পুলিশ হলেও অঞ্জলী ছোট জাতের। যেন তাকে বিরক্ত করার অধিকার আছে সবার। অন্যদিকে বেশ কয়েকবার অনুসন্ধানের স্বার্থে উচু জাতের ব্যক্তিদের বাড়িতে ঢুকতে চাইলে তাকে বাধা দেয়া হয়। সেখানে সরাসরিই তার জাত তুলে কথা বলতে শোনা যায়। 

সিরিজটিকে ‘‌ওয়েল মেড’ বলা যেতে পারে। অভিনয় সবাই নিজের মতো ভালো করেছেন। সোনাক্ষী সিনহা অনেকদিন পর নিজেকে নিয়ে নিরীক্ষা করার মতো একটি চরিত্র পেয়েছেন। অন্যদিকে তার সঙ্গে গুলশান দেবাইয়া, সোহম শাহ ভালো কাজ করেছেন। তবে সবচেয়ে আশা ছিল বিজয় বর্মাকে নিয়ে। বিজয়কে তার দক্ষতা অনুসারেই একটি চরিত্র দেয়া হয়েছিল। সে চরিত্রে ছিল অনেক স্তর। কিন্তু সে স্তরগুলো কেন যেন নির্মাতারা বের করে আনার চেষ্টা করেননি। হিন্দির শিক্ষক আনন্দ স্বর্ণকার বাস্তব ও পরিবেশের কাছে যে দুটি ভিন্ন চেহারা নিয়ে বাস করেন, তা নিয়ে আরো বেশি এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ ছিল। কিন্তু তা না করে অনেকটাই রৈখিক গতিতে এগিয়েছেন নির্মাতারা। শেষের দুই পর্ব যেন পুরো সিরিজকে সংজ্ঞায়িত না করে একটি টাইপড সমাপ্তি দেয়ার মধ্যেই রাখলেন তারা।

রাজস্থানের পুরো প্রকৃতি বা মানুষকে তুলে ধরা হয়নি সিরিজে। কয়েকটি উদ্দেশ্য পূরণ করা হয়েছে। যেমন এ সময়ে নারীদের অবস্থান। তাদের সহজ লক্ষ্য হিসেবে পরিণত করে হত্যা। একজন ব্যক্তির একান্ত পরিকল্পনার মধ্যে তাদের ঢুকে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ই সিরিজের গল্পে মুখ্য হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে অঞ্জলীর জাত ও অন্যান্য বিষয়। তবু এর মধ্যেই কয়েকটি দৃশ্য দর্শকের চোখে ভালো লাগবে। যেমন সোহমের একটি টিলায় উঠে বসে থাকা, অলিগলি দিয়ে অঞ্জলীর যাত্রা ইত্যাদি। পাশাপাশি বাস্তবতার নিরিখে সিরিজে দেখানো হয়েছে আঞ্চলিক পুলিশ স্টেশন। একটি পুরনো দালানে সে স্টেশনটি। সেখানে আধুনিক ব্যবস্থা নেই। একদম ‘‌রুট লেভেল’ থেকেই গল্পটি বলা বা গল্পে সে স্থানটি দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

চিৎকার নানা রকম হতে পারে। কখনো গলাবাজি করে চিৎকার করা হয়, কখনো কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি করেও চিৎকার করা যায়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ নিজের ভেতরকার ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে না। এ সিরিজে অঞ্জলী, দেবী লাল সিং (গুলশান), কৈলাশ (সোহম) এমনিক আনন্দের (বিজয়) মধ্যেও সে ক্ষোভ ছিল। প্রত্যেকের সে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ হয়েছে তাদের কাজের মধ্য দিয়ে। কেউ ভালো কাজ করেছেন আর কেউ খারাপ। কিন্তু চিৎকার সবার নীরবতার মধ্যেই ছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন