পর্যটন খাত বিকাশে বিলাসপণ্য আমদানির বিষয়টি ভাবা উচিত

দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত পর্যটন শিল্প। অনেক সীমাবদ্ধতায় সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আসন্ন বাজেটে পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা এবং এ শিল্পের বিকাশে করণীয় নানা দিক নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আল ফাতাহ মামুন

বাংলাদেশে পর্যটন খাতের সম্ভাবনা কেমন?

অবশ্যই পর্যটন খাত আমাদের দেশে সম্ভাবনাময়। কিন্তু আমার মনে হয়, সম্ভাবনার শুরুটা আমরা এখনো করতে পারিনি। আমরা দুদিক দিয়ে ভাগ্যবান ছিলাম। একটা হলো আমাদের দেশীয় অনেক পর্যটক আছে। এটা ১৭ কোটি মানুষের দেশ। আমরা প্রতিনিয়তই বলছি, আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। যখন মাথাপিছু আয় বাড়বে, তখন অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাত স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বড় হবে। আমরা মনে হয় সে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি। আর দ্বিতীয় সৌভাগ্যটি হলো, বিদেশী পর্যটক। যখন দেশীয় পর্যটকরা খুশি থাকবে, তখন বিদেশী পর্যটকরাও আসবে। আমাদের বিদেশী পর্যটক যারা আসে, তাদের সংস্কৃতি ও সমাজের অনেক কিছু দেখার বাইরেও আরো কিছু চাওয়ার থাকে। যেগুলো হয়তোবা আমাদের দেশের সংস্কৃতি, আমাদের বেড়ে ওঠা ও আমাদের চারদিকের দৃশ্যের সঙ্গে মেলে না। পর্যটক চায় তার মতো করে সুযোগ-সুবিধা থাকুক। এটা যখন আমরা নিশ্চিত করতে পারব, তখন দেশী-বিদেশী দুই ধরনের পর্যটকের সংখ্যাই বাড়বে। এজন্য আমাদের আরো কিছু পথ পাড়ি দিতে হবে। আরো চেষ্টা করতে হবে। সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে। 

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পর্যটন খাতের বিকাশে কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?

প্রথম প্রয়োজনই হলো ট্যুরিস্ট চায় ভ্রমণবান্ধব পরিবেশ। দ্বিতীয়ত চায় নিরাপত্তা। আমাদের সিকিউরিটি সিস্টেমটা আরো উন্নত করতে হবে। কেবল সরকার বা পুলিশের একার পক্ষে ট্যুরিস্টের সিকিউরিটি দেয়া শতভাগ সম্ভব হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সবাই সচেতন না হব। পুরো সমাজ ও জনগণ, সবাইকে সচেতন হতে হবে। যে ট্যুরিস্টের ওপর সমস্যা তৈরি করছে বা ট্যুরিস্ট যেটাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সেটা তো সরকার করছে না, করছি আমাদেরই কেউ একজন। সে বিষয়গুলো যখন সঠিকভাবে তুলে আনা যাবে ও সমাধান নিয়ে কাজ করা যাবে, তখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ই আমাদের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। 

বাংলাদেশে পর্যটন খাতে বিনিয়োগের পরিবেশ কেমন? 

বিনিয়োগের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে দেখেই বিনিয়োগ আসছে। আমার ধারণা, পর্যটন খাতে আমাদের অবস্থান আছে। দ্য প্যালেস রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পারমিশন পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা দীর্ঘসূত্রতার বিষয় থাকে। আমি আগেই বলেছি, আমাদের যে সমাজ, এ সমাজ ব্যবস্থায় সবাইকে নিয়ে সচেতন হতে হবে। আমাদের সমাজের অনেকেই পর্যটকদের অনেক কিছু নিয়ে ওয়েলকামিং নয়। রিসোর্টে ফান থাকবে, গেম থাকবে, অনেক কিছু থাকবে। অনেক ফান, অনেক গেম আমরা তো সহজভাবে নিতে পারি না। সেটা সামাজিক মূল্যবোধ বলেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ বলেন, সেগুলো বজায় রেখেও যে ফান-গেম করা যায়, এটা অনেকে সহজভাবে নিতে পারেন না। 

দেশের পর্যটকদের বড় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। গত কয়েক দশকে মেগা অবকাঠামো আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বড় আঘাত হেনেছে। পর্যটক আকর্ষণে এতে কোনো নেতিবাচক ভূমিকা পড়বে বলে মনে করেন কি?

বিদেশী পর্যটকরা পরিবেশ নিয়ে খুবই সচেতন। এ নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। আবার আপনাকে এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে, বাংলাদেশ খুব ছোট একটা দেশ। আয়তন ছোট, মানুষ অনেক বেশি। আপনি যদি উজবেকিস্তান বলেন, সেখানে ট্যুরিজম ডেভেলপ করছে। সেখানে মাত্র সাড়ে তিন কোটি মানুষ। অথচ দেশটা আমাদের চেয়ে অনেক বড়। যে সুবিধাগুলো তারা পাচ্ছে, আমরা চাইলেও তা পাব না। আমাদের এত মানুষ। আমাদের অবকাঠামো হবেই। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, পরিবেশ রক্ষা করে অবকাঠামো করা যায় কিনা। সেটার জন্য চেষ্টা করা যেতে পারে। ঘুরেফিরে একই কথা। আমাদের সচেতন হতে হবে। ভবিষ্যতে অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। সেন্টমার্টিনে যখন অনেক বাড়িঘর অবকাঠামো বানাবেন, তখন সেখানে ট্যুরিস্ট যেতে চাইবে না বা যেতে পারবে না। সেখানে একটা কোনো বিশেষ অঞ্চল করা যায় কিনা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। 

পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের উদ্যোগ শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি আপনারা কীভাবে দেখছেন? 

আমার কাছে মনে হয়, এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। আপনি একটু আগেই পরিবেশের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। সাবরাংয়ে যেটা হচ্ছে, চারদিকে পানি বেষ্টিত একটা জায়গা। সে জায়গায় পরিবেশ নষ্ট হবে? অবশ্যই নষ্ট হবে। যখন মানুষ বাড়বে, পরিবেশের ওপর একটা প্রভাব পড়বে। আমাদের টার্গেট রাখতে হবে, কীভাবে পরিবেশ ঠিক রেখে ট্যুরিজম করা যায়। যদি নির্দিষ্ট নিয়ম করে অর্থনৈতিক অঞ্চলটাকে প্রমোট করা যায়, আমার মনে হয়, ভালো হবে। সেখানে আমাদের দেশীয় যারা বিনিয়োগকারী থাকবে, তাদের বিশেষ সুবিধা দিতে হবে সরকারের পক্ষ থেকে। একই সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগও আনতে হবে, যারা অলরেডি ট্যুরিজমে ভালো করেছে। তাহলে আমরা তাদের থেকেও শিখতে পারব। 

পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে বাজেটে আপনাদের প্রত্যাশা কী? 

আপনি নিজেই দেখছেন ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানিতে একটা ধীরগতি চলে এসেছে। কেনাকাটায় আমরা নিরুৎসাহিত করছি। বিশেষ করে বিলাসদ্রব্যের বেলায়। ট্যুরিস্ট সবসময় ল্যাক্সারি আইটেম পেতে চান। নয়তো তিনি ঘরেই থাকতে পারতেন। এ জায়গায়ই আমার মনে হয় নীতিনির্ধারক বা সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন। তাদের ভাবতেই হবে। তাহলে সামনে আমাদের যে সংকটের সময় থাকবে, সামনের এক বছর বা দেড় বছর, তখন আমরা ভালোভাবে কাটাতে পারব। 

পর্যটকদের নিরাপত্তায় কী করণীয় সুনির্দিষ্টভাবে যদি বলতেন। 

সর্বপ্রথম সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আমরা একটা জোরালো চেষ্টা করতে পারি। একদম স্কুল পর্যায় থেকেই পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি শেখাতে হবে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় একেবারে স্কুল থেকেই বলা হয়, আমরা একটি ট্যুরিস্ট কান্ট্রি। আমাদের দেশে প্রচুর ট্যুরিস্ট আছে। ট্যুরিস্টের সঙ্গে এ আচরণ করতে হবে। এ আচরণ করা যাবে না। আমরাও যদি স্কুল লেভেল থেকেই ট্যুরিজম ও হসপিটালিটিকে প্রমোট করতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য ভালো হবে। বিষয়টা খুব কঠিন নয়। 

দেশে ইকো ট্যুরিজম নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায় কিনা?

অবশ্যই যেতে পারে। ইকো ট্যুরিজমের অংশই পরিবেশ। শুরুতে আপনি যে প্রশ্ন করেছিলেন, পরিবেশ ঠিক হলে ইকো ট্যুরিজমসহ অন্য বিষয়গুলো ডেভেলপ হবে। অবশ্যই ইকো ট্যুরিজম প্রমোট করা উচিত। পরিবেশবান্ধব ট্যুরিজমে আমরাও কিছু উদ্যোগ নিচ্ছি। ভবিষ্যতে আরো বেশি পরিবেশবান্ধব করার চেষ্টা করছি। আমাদের দ্য প্যালেস রিসোর্টে ধীরে ধীরে সোলারের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করছি। সুইমিং পুলের পানি রিসাইক্লিংয়ের চেষ্টা করছি। 

পর্যটন খাতের বিকাশে ব্র্যান্ডিংয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলুন।

ব্র্যান্ডিং অবশ্যই লাগবে। শুরুতেই আমি নিরাপত্তার বিষয়ে বলেছি। ট্যুরিস্ট এসে নিরাপত্তা পাবেন, এটাও একটা ব্র্যান্ডিংয়ের বিষয়। আপনি যদি ভারতের কোনো জায়গায় যান, সেখানে ট্যুরিস্টদের ব্যাপারে বলাই আছে, ইউ ক্যান ওয়াক অ্যানি টাইম। ওই জোনটা পুরোপুরি সিকিউরড। এটাও কিন্তু ব্র্যান্ডিংয়ের একটা অংশ। তার সঙ্গে আমাদের দেশে কী কী আছে, ট্যুরিস্টকে আমি কী কী সেবা দেব, কোন সমস্যায় পড়লে ট্যুরিস্ট আমার থেকে কী সহযোগিতা পাবে, এগুলো সবই ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ। মনে রাখতে হবে, পর্যটক আকর্ষণের জন্য কেবল অবকাঠামো ডেভেলপমেন্টই শেষ নয়, এর বাইরে যখন এয়ারপোর্টে এসে নামবে, সেখানে সে কাঙ্ক্ষিত সাপোর্টটা পাবে কিনা? এ দেশ থেকে তার কানেক্টিভিটি ফ্লাইট অন্য দেশে আছে কিনা এবং বিমানের ভাড়াটা কী অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের দেশে বেশি না কম। যদি এসব বিষয়ে ট্যুরিস্ট সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে কিন্তু আমাদের দেশে আসবে না। এসব সমন্বয় করেই আমাদের এগোতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন