সময়ের ভাবনা

দ্বৈত নাগরিকত্ব: চর্বি ভাঙিয়ে চলার গল্প

পাপলু রহমান

সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষের যাত্রা প্রবহমান। তারা এক জায়গায় বাঁধা থাকতে চায় না। প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ানোর, উড়ে বেড়ানোর সাধ করে। উন্নত জীবন, নিরাপদ খাদ্য, কর্ম ও বাসস্থানের নিশ্চয়তার কারণে কিছু মানুষ দেশান্তরী হয়। শুধু কি মানুষ? এ প্রবণতা প্রাণিকুলেও আছে। মাইগ্রেটরি বা অতিথি পাখির কথা আমরা জানি। বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে তারা স্থানান্তরে চলে যায়। শত শত, এমনকি হাজার মাইলের সুনির্দিষ্ট পথ ডিঙিয়ে তারা দূরান্তের গন্তব্যে ছোটে। এর জন্য থাকে সুনিবিড় প্রস্তুতি। দলবেঁধে ওড়ার আগে পর্যবেক্ষক পাখি কমিটি গন্তব্যের মান যাচাই করতে আগেই পৌঁছে যায়। পরে অতিথি পাখিরা পৌঁছলে তাদের স্বাগত জানায়।

অতিথি পাখিদের এ যাত্রা ট্যুরের মতো মনে হতে পারে। বাস্তবে জলবায়ু, তাপমাত্রা বা আবহাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচতে তারা নতুন দিগন্ত বেছে নেয়। এদিকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয়া পাখিরা যাত্রা আরম্ভকালে বেশি বেশি খেয়ে, বিশ্রাম নিয়ে শরীরে তেল-চর্বি জমিয়ে ফেলে। যাতে বহুদূর গিয়ে তাদের খাদ্যের প্রয়োজন না পড়ে। নিজেদের শরীরের চর্বি ভাঙিয়ে চলতে পারে। 

পরিযায়ী পাখিদের সঙ্গে মানুষের অনেক মিল রয়েছে। অনেকে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ নিয়ে দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার করেন, যাতে পরদেশে চলতে অসুবিধা না হয়। নিরাপদ ও নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারেন। অনেকটা পাখিদের চর্বি ভাঙিয়ে চলার মতো। পাখিরা তো একটা নির্দিষ্ট সময় পরদেশে থেকে নিজ দেশে ফিরে আবার বসতি গড়ে। কিন্তু নিজ দেশে ফেরার জন্য মানুষ কি পরদেশে সেকেন্ড হোম, অর্থসম্পদ কিংবা নাগরিকত্ব গ্রহণ করে?

সম্প্রতি বাংলাদেশীদের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্বের পরিসর বাড়িয়েছে সরকার। এর আগে ইউরোপ-আমেরিকাসহ মোট ৫৭টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা মিলত। নতুন করে সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরো ৪৪টি দেশ। সব মিলিয়ে এ সুবিধার আওতায় এসেছে ১০১টি দেশ। অর্থাৎ এসব দেশে বাংলাদেশীরা চাইলে নাগরিকত্ব নিতে পারবেন। এজন্য বাংলাদেশের নাগরিকত্বও বিসর্জন দিতে হবে না। তারা বৈধভাবে বাংলাদেশসহ অন্য দেশে দ্বৈত নাগরিকত্ব অব্যাহত রাখতে পারবেন। নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়তনের অধিক জনসংখ্যার দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারের অবৈধ সব কর্মকাণ্ড। চলতি বছরের শুরুতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির বরাতে দৈনিক বণিক বার্তা জানিয়েছে, তথ্য গোপন করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন ৪৫৯ বাংলাদেশী। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। শুধু কি তাই! ইউরোপের অনেক দেশেও বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে সম্পদ ও অর্থ পাচারের খবর জানিয়েছিল পত্রিকাটি। অভিবাসনসংক্রান্ত সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান লন্ডনভিত্তিক অ্যাস্টনস ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের বিভিন্ন এলাকার বিদেশী প্রপার্টি ক্রেতাদের জাতীয়তাভিত্তিক একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ওই তালিকায় দেখা যায়, প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের বিদেশী প্রপার্টি ক্রেতাদের তালিকায় বাংলাদেশীদের অবস্থান নবম। ২০২০ সালের ওই নয় মাসে সেখানে ৯৮টি লেনদেনের মাধ্যমে বাংলাদেশীরা প্রায় ১২ কোটি ২৯ লাখ পাউন্ড মূল্যের প্রপার্টি কিনেছেন। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এসব লেনদেনে গড় ব্যয় হয়েছে প্রায় ১২ লাখ পাউন্ড বা প্রায় ১৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। এছাড়া দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের স্থানান্তরের মাধ্যমে অবৈধভাবে কাজ দেয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি সম্পদ বিক্রি করে অর্থ নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।

দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবাদে নাগরিকরা ওই দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সরাসরি আমানত রাখতে পারেন। নাগরিকত্ব পেলে ওই দেশেই যাবতীয় সুবিধা নেবেন, প্রয়োজন মেটাবেন ও কর দেবেন। অনেকে কর এড়ানোর জন্য নিজ দেশের অব্যবহৃত সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে অর্থ নিয়ে যান। তাদের কাছ থেকে নিয়মিত বৈদেশিক মুদ্রা যে আসবে না, তা বোঝাই যায়। মনে রাখা দরকার, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ আসে অভিবাসী শ্রমিকদের কাছে থেকে। তাদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সই আমাদের রিজার্ভের বড় একটি অংশ। 

সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে শুধু যে অর্থ পাচারের দিকটি সামনে এসেছে তা নয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে মেধা পাচারের উদ্বেগ কিছুটা হলেও বাড়ছে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এখন বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে কিংবা চেষ্টা করছে। এমনকি উচ্চবিত্ত অনেক শ্রেণীর সন্তানই দ্বৈত নাগরিকত্বের আওতায় আসছে। তাদের বেশির ভাগেরই দেশে ফেরার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত বিদেশী শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রকাশিত ‘ওপেন ডোরস-২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বিশ্বের ২৫ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৩তম। বর্তমানে দেশটিতে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজার ৫৯৭। শুধু আমেরিকা কিংবা ইউরোপ নয়, এখন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের কাছে উচ্চশিক্ষার শীর্ষ গন্তব্য হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত কিউএস র‍্যাংকিংয়ে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান ১৫০-এরও পরে। তার পরও গত বছর বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে বিদেশে পাড়ি জমানো শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশিসংখ্যকই গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবি ও দুবাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়।

জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) বলছে, বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এখন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ইউএই। ২০২২ সালে ১১ হাজার ১৫৭ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন আবুধাবি ও দুবাইসহ ইউএইর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। সে হিসেবে গত বছর বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়া মোট শিক্ষার্থীর ২২ শতাংশই গেছেন ইউএইতে। যদিও এর আগে কখনই বিদেশে উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশীদের গন্তব্য হিসেবে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়ও ছিল না দেশটি (সূত্র: বণিক বার্তা, ১৬ মার্চ, ২০২৩)। উচ্চশিক্ষায় শীর্ষ গন্তব্যের এ পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থ পাচারের মতো বিষয়গুলোর যোগসূত্র থাকতে পারে। এছাড়া দ্বৈত নাগরিকদের পক্ষে এক দেশে অপরাধ করে অন্য দেশে নিরাপদে থাকা সম্ভব। তারা ঋণ খেলাপি ও কর ফাঁকি দেয়ারও সুযোগ পেয়ে যান। 

দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ পাচারের প্রবণতা নতুন নয়। প্রতি বছর এ ধরনের ঘটনার কিছু প্রকাশ পায়। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ সেখানে বিনিয়োগ করেন পাচারকারীরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে শুধু পণ্য আমদানি ও রফতানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমেই বছরে অর্থ পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। দ্বৈত নাগরিকত্ব বিবেচনায় অর্থ পাচার রোধে দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। সেক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর আরো উদ্যোগী হওয়া উচিত। দ্বৈত নাগরিকত্ব কিংবা স্থায়ী অভিবাসী শব্দের সঙ্গে ‘‌অর্থ পাচার’, অর্থ লুট’ শব্দগুলোর অবসান ঘটাতে হবে।

দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ বাড়ানোর সিদ্ধান্তে কূটনৈতিক স্বার্থ থাকতে পারে। অনেকে এটির ইতিবাচক দিকও দেখতে পাচ্ছেন। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে দেশে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তবে এ সুযোগ বাংলাদেশীরা যে খুব কমই গ্রহণ করবেন তা অনুমেয়। সরকারের দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ বাড়ানোর পেছনে নিশ্চয়ই বড়সড় পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু সে পরিকল্পনা কী, এতগুলো দেশে কেন দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ দেয়া হলো, তা স্পষ্ট নয়। আর এ সিদ্ধান্তে দৃষ্টিগ্রাহ্য যেসব সমস্যা রয়েছে, তাতে হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

আরেকটি বিষয়, মানুষের যদি জন্মভূমির প্রতি টান না থাকে, যদি সে না চায় তার জীবনের শেষ দিনগুলো স্বদেশের মাটিতে কাটবে কিংবা অনন্ত নিদ্রা ঘটবে, তাহলে আখের গুছিয়ে নিয়ে দেশত্যাগীর সংখ্যা বাড়বে। এক্ষেত্রে দেশের প্রতি ভালোবাসা, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করাও ভাবনার বিষয়।

পাপলু রহমান: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন