কভিড-পরবর্তী জটিলতা

কভিড-পরবর্তী জটিলতা ও করণীয়

ছবি: মাউন্ট এলিজাবেথ ডটকম

বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবী কভিড-১৯  অতিমারীর আক্রমণের আঁধার ঢাকা সময় থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে এসেছে। আমরা এখন কভিড-পরবর্তী নিউ নরমাল জীবনে প্রবেশ করেছি। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান নগরীতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সার্স কোভ-২ ভাইরাসটি প্রথম চিহ্নিত হয়, যা কভিড-১৯ ব্যাধিটির জন্য দায়ী। পরবর্তী সময়ে তা পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭৫ কোটির অধিক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশে এযাবৎ আক্রান্ত হয়েছে ২০ লাখের অধিক মানুষ আর এর বিপরীতে মারা গেছেন প্রায় ৩০ হাজার জন। 

প্রাথমিকভাবে কভিড-১৯ ফুসফুসকে আক্রান্ত করলেও শরীরের অন্যান্য যেকোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই এর কবলে পড়তে পারে। ধারণা করা হয়, মোট আক্রান্তের শতকরা ১০-১৫ ভাগ রোগী তীব্র মাত্রার কভিডে ভুগেছিলেন ও তাদের চিকিৎসায় অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়েছিল। কভিড আক্রান্তদের মধ্যে অনেকেই অন্যান্য রোগেও ভুগছিলেন। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্থূলকায় গঠন, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, হাঁপানি ও ক্যান্সারসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে যারা আক্রান্ত তাদের মধ্যে তীব্র মাত্রার কভিড সংক্রমণের প্রবণতা অনেক বেশি ছিল। 

বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণায় কভিড-পরবর্তী বেশকিছু জটিলতার চিত্র উঠে এসেছে। এসব সমস্যাকে একত্রে লং কভিড সিনড্রোম বা পোস্টকভিড-নাইন্টিন সিনড্রোম বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন গাইডলাইন অনুযায়ী কভিড-১৯-এর লক্ষণগুলো চার সপ্তাহের বেশি থেকে গেলে অথবা কভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠার চার সপ্তাহ পর নতুন করে কোনো উপসর্গ দেখা দিলে তাকে লং কভিড সিনড্রোম বলে। 

সম্প্রতি নেচার সায়েন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ৫০-এর অধিক কভিড-পরবর্তী জটিলতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পোস্টকভিড ক্লিনিকে পরিচালিত গবেষণায়ও কভিড-পরবর্তী বিভিন্ন জটিলতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। নেচার জার্নালের গবেষণা প্রবন্ধ মতে, কভিড-১৯-এ আক্রান্ত (মৃদু, মাঝারি ও তীব্র সংক্রমণ) ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশই বিভিন্ন রকম জটিলতায় ভুগছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো অল্পতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া (৫৮%), মাথাব্যথা (৪৪%), মনঃসংযোগে ব্যাঘাত (২৭%), চুল পড়ে যাওয়া (২৫%), শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হওয়া, শুষ্ক কাশি (১৯%), ঘুমের ব্যাঘাত (১৯%), স্মৃতিভ্রম (১৬%), বুক ধড়ফড় করা (৮%) ইত্যাদি। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অনুযায়ী বিবেচনা করলে ফুসফুস, স্নায়ুতন্ত্র, হৃৎপিণ্ড, বিভিন্ন রকমের ইনফেকশন ইত্যাদি লক্ষণগুলোই বেশি দেখা যাচ্ছে।

ফুসফুসের সমস্যার মধ্যে শুকনো কাশি, ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া, অল্প পরিশ্রমে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া ও লাং ফাইব্রোসিস (ফুসফুসের সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া) প্রভৃতি সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ধরনের সমস্যায় কেউ ভুগে থাকলে মেডিসিন অথবা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। সাধারণত বিশেষজ্ঞরা এসব উপসর্গ থাকলে পালমোনারি ফাংশন টেস্ট, ৬ মিনিট হাঁটার পরীক্ষা (ওয়াকিং টেস্ট), বুকের এক্স-রে এবং ইকোকার্ডিওগ্রাম করে থাকেন। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের (ব্রেথিং এক্সারসাইজ) ব্যাপক উপকারী ভূমিকা রয়েছে। বিভিন্ন রকমের ফুসফুসের ব্যায়ামের জন্য ইউটিউবে অনেক ভিডিও পাওয়া যায়। যারা এসব সমস্যায় ভুগছেন, তারা এ ধরনের ভিডিও দেখতে পারেন ও নিয়মিত ব্যায়ামগুলো চালিয়ে যেতে পারেন। হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে বুকে চাপ লাগা এবং হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া অন্যতম প্রধান সমস্যা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যাগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যারা এসব সমস্যায় ভুগছেন তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। এসব ক্ষেত্রে দুই-একটি কার্যকরী ওষুধের প্রমাণ বিভিন্ন গবেষণায় অতিসম্প্রতি উঠে এসেছে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে এসব সমস্যা কটিয়ে ওঠা সম্ভব।

স্নায়ু ও মানসিক সমস্যাগুলোর মধ্যে নিদ্রাহীনতা, অবসাদগ্রস্ততা, মনঃসংযোগের ব্যাঘাত, স্মৃতিভ্রম দেখা যাচ্ছে বেশি। অ্যামেরিকান সাইকিয়াট্রি অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) ও রয়েল কলেজ অব অকুপেশনাল থেরাপিস্টসের (আরসিওটি) মতে, এসব সমস্যার জন্য ওষুধ খুব একটা কার্যকর ব্যবস্থা নয়। সম্প্রতি পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় তেমন কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি। এসব ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত শারীরিক ও মানসিক বিশ্রামের ওপর অনেক বেশি জোর দেয়া হয়েছে। টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার অযাচিত ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারলে চোখ এবং মস্তিষ্কের বিশ্রাম নিশ্চিত করা সম্ভব। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের রিলাক্সেশন এক্সারসাইজ বা মেডিটেশন করা যেতে পারে। বই পড়া, গান শোনা, ধর্মীয় আচার পালন ইত্যাদি মেডিটেশনের অংশ হিসেবে কার্যকর হতে পারে। ন্যূনতম ৮ ঘণ্টা ঘুমের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়া পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ (বিভিন্ন রকমের ফলমূল ও সবজি), নিয়মিত ব্যায়াম করা, একটানা অনেকক্ষণ কাজ না করা, সামাজিক ও পারিবারিক যোগাযোগ বাড়ানো, গল্প-আড্ডার মাধ্যমে একে অন্যকে সহযোগিতা করা এবং দৈনন্দিন কাজকর্মের পাশাপাশি সুস্থ বিনোদনের জন্যও কিছু সময় সংরক্ষণ করা ইত্যাদি স্নায়ু এবং মননজনিত সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে কার্যকরভাবে সহায়তা করবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার এবং ইলেকট্রোলাইট ড্রিংক পান করার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে।

ফুসফুস, হৃদযন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রের পর কভিড-পরবর্তী বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশনে আক্রান্ত হচ্ছে একটি বড় অংশের রোগী। কভিড-১৯ মহামারীর চরম সময়ে স্টেরয়েড, অ্যান্টিবায়োটিক এবং আরো কিছু দামি বায়োলজিক ওষুধের প্রচুর ব্যবহার হয়েছে। এসব কারণে পরবর্তী সময়ে কভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের মধ্যে ফুসফুস এবং ফুসফুসের বাইরের অন্যান্য অঙ্গের টিউবার কিউলোসিস (টিআরবি) বা যক্ষ্মা রোগ, বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণ, ফাঙ্গাল ইনফেকশন ইত্যাদি বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হচ্ছে। যারা এর আগে তীব্র কভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়েছিল, তারা জ্বরে আক্রান্ত হলে যথেষ্ট সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এ ব্যাপারে মেডিসিন এবং সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে। এছাড়া যারা আগে থেকে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ এবং থাইরয়েড-সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছেন, তাদের প্রতি ছয় মাস থেকে এক বছর পরপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে ফলোআপ করা প্রয়োজন। প্রতি বছর অন্তত একবার ইসিজি করানো, নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করানো এবং বছরে একবার কৃমিনাশক ওষুধ সেবনের ব্যাপারেও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

পরিশেষে, কভিডকালে আমাদের ভেতর জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কিছু অভ্যাস, যেমন: বাইরে বের হলে মাস্ক পরিধান করা, নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করা এবং ভিড় ও জনসমাগম পরিহার করা ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল। নিউ নরমাল জীবনে আগের এ অভ্যাসগুলো মেনে চলার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশেষভাবে জোর দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো যেসব দেশে অতিমাত্রায় বায়ুদূষণ রয়েছে, সেসব দেশে মাস্ক পরে বাইরে বের হলে বা জনসমাগমে গেলে ফুসফুসের নানাবিধ সমস্যা থেকেও দূরে থাকা যাবে। কভিড-১৯ অতিমারী পৃথিবীর জন্য সর্বশেষ অতিমারী নয়। ভবিষ্যতে এ রকম আরো অতিমারী আসতে পারে। জনস্বাস্থ্যমূলক উপরিউক্ত নিয়মকে অভ্যাসে পরিণত করাই রোগ থেকে পরিত্রাণের উপায় হতে পারে। 


ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী: সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন