ডলার সংকটে আমদানি করা যাচ্ছে না কাঁচামাল

বাজার নিয়ে শঙ্কায় আইসক্রিম শিল্পের উদ্যোক্তারা

মেহেদী হাসান রাহাত

দেশে আইসক্রিমের বাজার বড় হচ্ছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই। খাতটির বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ১৫ শতাংশে। কভিডের প্রভাবে প্রায় দুই বছর ব্যবসা কমলেও গত বছর আবার ঘুরে দাঁড়ায় আইসক্রিম শিল্প। এর মধ্যেই আবার দেখা দিয়েছে নতুন সংকট। ডলার সংকটের প্রভাবে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য না হওয়ায় কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন আইসক্রিম খাতের উদ্যোক্তারা। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে না পারলে আইসক্রিমের বাজার ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কায় প্রকাশ করেছেন তারা।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছরের শেষ প্রান্তিকের শুরু অর্থাৎ অক্টোবর থেকেই আইসক্রিমের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের। ডলার সংকটের কারণে সরকারের পক্ষ থেকেও জোর দেয়া হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির ওপর। এর বিপরীতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বিলাসপণ্য অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন পণ্য আমদানি। আইসক্রিম শিল্পে প্রয়োজনীয় কাঁচামালগুলো (যেমন ভেজিটেবল ফ্যাট, চকোলেট, দুধ, ফ্লেভারিংস, ক্রিম, ফুড কালার ইত্যাদি) সরকার ঘোষিত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আওতায় পড়ে না। কারণে এগুলো আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকের কাছে ডলার পাচ্ছেন না শিল্পটির উদ্যোক্তারা।

শীতকাল হওয়ায় দেশে এখন আইসক্রিমের চাহিদা কম। তবে পণ্যটির চাহিদা আবারো বাড়তে শুরু করবে মার্চে। কারণে এখন থেকেই কাঁচামাল আমদানি করে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহের প্রস্তুতি নিতে চাইছে কোম্পানিগুলো। মুহূর্তে কিছু কাঁচামাল থাকলেও তা বাজারের চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

আইসক্রিম শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, কভিডের সময় থেকেই বিভিন্ন কাঁচামালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। পাশাপাশি জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়ায় ব্যবসার ব্যয় বেড়েছে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কাঁচামাল আমদানিতেও তাদের বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চাইলেও আইসক্রিমের দাম খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব নয়। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য না হওয়ায় দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে ভোক্তারা আইসক্রিম কেনা বাদ দেবে। কিন্তু উদ্যোক্তারা শিল্পটিতে ব্যবসায় নেমেছেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। আপাতত লাভের আশা বাদ দিয়ে বাজার ধরে রাখার বিষয়েই মনোযোগ তাদের। কিন্তু চাহিদামতো কাঁচামাল আমদানি করতে না পারলে সেটিও সম্ভব হবে না। অবস্থায় আইসক্রিম শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

খাতসংশ্লিষ্টদের দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে আইসক্রিমের বাজারের আকার বর্তমানে হাজার ২০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার। কভিডের সময়টুকু বাদ দিলে টানা পাঁচ বছর শিল্পটির ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫-২০ শতাংশের মধ্যে। মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ায় গত বছরও ভালো ব্যবসা করেছে আইসক্রিম কোম্পানিগুলো।

দেশের আইসক্রিমের বাজারে মুহূর্তে সবচেয়ে পুরনো শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড আব্দুল মোনেম লিমিটেডের ইগলু। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামে কোকা-কোলার বোতলজাত কারখানার অভ্যন্তরে যাত্রা হয় ইগলুর। পরের বছরই তারা ঢাকায় চালু করে প্রথম আইসক্রিম পার্লার। ১৯৭২ সালে ইগলুকে জাতীয়করণ করে নেয় সরকার। ব্র্যান্ডটির মালিকানা পায় বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন। ১৯৮৩ সালে সরকারের বেসরকারীকরণ স্কিমের আওতায় কোকা-কোলার বোতলজাত কারখানাসহ ইগলুকে কিনে নেয় আব্দুল মোনেম লিমিটেড। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখে আব্দুল মোনেম লিমিটেড। এরপর তা স্থানান্তরিত হয় নারায়ণগঞ্জের বর্তমান কারখানায়।

ইগলুর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শামীম আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্রের মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানি একেবারে বন্ধ হয়নি। তবে সীমিত পরিসরে আমদানি করতে হচ্ছে। গত বছর আমাদের ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। পণ্যের দামের হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৭ শতাংশ এবং পণ্য বিক্রির পরিমাণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ শতাংশ। চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল আমদানি করতে না পারলে আইসক্রিমের চাহিদা যদি বছর আগের মতোও থাকে তাহলেও সব কোম্পানি মিলে বাজারে পণ্য সরবরাহে হিমশিম খাবে।

দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ আইসক্রিম ব্র্যান্ড ঢাকা আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিজের পোলার। ১৯৮৬ সালে যাত্রা করে ব্র্যান্ডটি। ফুড গ্রেড প্লাস্টিকের বক্সে আইসক্রিম বাজারজাত করার মাধ্যমে দ্রুতই জনপ্রিয়তা পায় ব্র্যান্ডটি। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত কারখানার পাশাপাশি গত বছর সাভারের খাগানে নতুন আরেকটি কারখানা স্থাপন করে পোলার। এটি স্থাপনে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে কোম্পানিটি। গত বছর নতুন কারখানায় পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। বছর থেকেই সেখানে পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে ঢাকা আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিজ।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) শাহ মাসুদ ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের আইসক্রিম শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির বিষয়ে আমরা খুবই আশাবাদী। বছর আমাদের নতুন কারখানা বাজার চাহিদা ভালোভাবে মেটাতে সাহায্য করবে বলে আশা করছি। আমদানিনির্ভর কাঁচামালগুলোর জোগান দ্রুত নিশ্চিত করা গেলে বছরও প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারবে শিল্পটি।

দেশের আইসক্রিমের বাজারে অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড লাভেলো। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা করে ব্র্যান্ডটি। লাভেলো আইসক্রিমের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাওফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম পিএলসি দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। সর্বশেষ ৩০ জুন সমাপ্ত ২০২২ হিসাব বছরে কোম্পানিটির বিক্রি হয়েছে ৯৬ কোটি টাকা। আগের হিসাব বছরে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৮৫ কোটি টাকা।

তাওফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাতো প্রকৌশলী মো. একরামুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে গত বছরের শেষ প্রান্তিক থেকেই আমরা কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে পারছি না। যদিও আমাদের কাছে কিছু কাঁচামাল মজুদ করা আছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। আগামী মার্চ থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হলে ঋণপত্র খোলার বিষয়ে আমাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু মার্চেই আমাদের ব্যবসার মৌসুম শুরু হয়ে যাবে। ফলে আগে থেকেই কাঁচামাল আমদানি করতে না পারলে বাজারে চাহিদা অনুসারে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।

দেশের আইসক্রিমের বাজারে থাকা অন্যান্য জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে সেনাকল্যাণ সংস্থার ব্র্যান্ড স্যাভয়। ১৯৯৫ সালে ব্র্যান্ডটি বাজারে আসে। ১৯৯৯ সালে বাজারে আসে সানোয়ারা গ্রুপের কোয়ালিটি আইসক্রিম। ২০১৩ সালে বাজারে আসে গোল্ডেন হারভেস্ট আইসক্রিমের ব্র্যান্ড ব্লুপ। কাজী ফার্মসের আইসক্রিম ব্র্যান্ড জানজি বেলিসিমোর যাত্রা ২০১৪ সালে। এছাড়া বাজারে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটার আইসক্রিমও পাওয়া যায়। এর বাইরে গুলশান, বনানী, বারিধারা ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকাভিত্তিক বেশকিছু বিদেশী আইসক্রিমের আউটলেটও রয়েছে।

বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান খাতসংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, আইসক্রিমের ব্যবসা মৌসুমভিত্তিক। এর মধ্যে এপ্রিল, মে জুন তিন মাস আইসক্রিমের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। এর বাইরে আইসক্রিম বেশি বিক্রি হয় মার্চ, জুলাই আগস্টে। ফেব্রুয়ারি, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর নভেম্বর চার মাস অফ-পিক মৌসুম। আর ডিসেম্বর জানুয়ারিতে শীতকালে আইসক্রিম তেমন একটা বিক্রি হয় না। সাত থেকে ১৬ বছর বয়সী ভোক্তার মধ্যে আইসক্রিম বেশি জনপ্রিয়। তাছাড়া পুরুষের চেয়ে নারীরা তুলনামূলক বেশি আইসক্রিম খায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন