মেট্রোরেল উদ্বোধন: আর মাত্র ৩ দিন

মেট্রোরেলেও ছাপ রেখে গেছেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী

শামীম রাহমান

রাজধানীর উত্তরায় মেট্রোরেলের ডিপোতে ভূমি ব্যবস্থাপনা কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রকল্পের ‘প্যানেল অব এক্সপার্টস’ দল। ছবিটি ২০১৭ সালে তোলা ছবি: ডিএমটিসিএল

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যত বৃহৎ ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে, তার প্রায় প্রত্যেকটিতে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু সেতু, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েদেশের বৃহৎ ভিত্তির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রেখেছেন প্রত্যক্ষ ভূমিকা। দেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণেও একেবারে শুরু থেকে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। প্রকল্পটির পরিকল্পনা পর্যায়ে সরকারের হয়ে পালন করেছেন পরামর্শকের দায়িত্ব। আর নির্মাণপর্যায়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন প্রকল্পের প্যানেল অব এক্সপার্টস দলের চেয়ারম্যান।

ঢাকার জন্য প্রথমবারের মতো মেট্রোরেল নির্মাণের সুপারিশ করা হয় ২০০৫ সালে প্রণীত ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) এটি তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লুইস বার্জার গ্রুপ ইনকরপোরেশন। এর রিভিউ কমিটির প্রধান ছিলেন . জামিলুর রেজা চৌধুরী। তবে এসটিপিতে মেট্রো নির্মাণের সুপারিশ না থাকায় রিভিউ কমিটি আপত্তি জানায়। এর পরই এসটিপিতে ঢাকার জন্য তিনটি মেট্রো লাইন অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে দাবি করেছেন নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, যিনি রিভিউ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বিষয়ে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তিনি যেখানে গিয়েছেন সেখানেই সফল হয়েছেন। আজকের মেট্রোরেল হওয়ার পেছনে তার একক চেষ্টা আমাদের সবার চেয়ে বেশি বলে মনে করি। এসটিপিতে ঢাকাবাসীর জন্য গণপরিবহন হিসেবে কেবল বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) আর কমিউটার ট্রেন রাখা হয়। মেট্রোর কোনো ধারণাই সেখানে ছিল না। জামিলুর স্যারের নেতৃত্বে আমরা বললাম, এটা কেমন কথা! এত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শহর কিন্তু মেট্রো থাকবে না, এমন উদাহরণ তো পৃথিবীর কোথাও নেই। আমরা জোর দিয়ে বললাম, মেট্রো যুক্ত করতে হবেই। তবে শুরুতে তারা বিষয়টি আমলে নেয়নি। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উল্টো আপত্তি করে বলেআমাদের চুক্তির শর্তে তো মেট্রোর কথা বলা নেই। সুতরাং মেট্রো যুক্ত করব কীভাবে? প্রফেসর জামিলুর রেজা, আর্কিটেক্ট তানভীর নেওয়াজ এবং আমিসহ আরো কয়েকজন জোর দিয়ে বললাম, ঢাকাবাসীর জন্য মেট্রো লাগবেই। আমাদের জোরালো দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তারা পরে মেট্রোর পরিকল্পনা যুক্ত করতে বাধ্য হয়।

শুধু ঢাকার জন্য মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনাই নয়, ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের গতিপথ ঠিক করতেও মুখ্য ভূমিকা রাখেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) করা সমীক্ষায় এমআরটি লাইন--এর রুট নির্ধারণ করা হয়েছিল উত্তরা, মিরপুর-১০, ফার্মগেট, শাহবাগ, পলাশী (বুয়েট), কাপ্তানবাজার হয়ে সায়েদাবাদ। দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ২২ কিলোমিটার। পরে রুটটিকে শাহবাগ থেকে সরিয়ে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন পর্যন্ত নেয়া হয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর সরাসরি ছাত্র ছিলেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ . সামছুল হক। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর সহযোগী হিসেবে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোর পরিকল্পনা নির্মাণপর্যায়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবেও কাজ করেছেন। এতে জামিলুর রেজা চৌধুরীর অবদান সম্পর্কে . সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, মেট্রোটির গতিপথ ঠিক করার জন্য আমরা দুইবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি। দুইবারই গিয়েছিলাম স্যারের নেতৃত্বে। গতিপথের ব্যাপারে যতটুকু কারিগরি অবদান আমরা রেখেছি, তার পুরোটাই হয়েছিল জামিলুর স্যারের নেতৃত্বে। তিনি বলেন, সে সময় বার বার গতিপথ বদলানোর কারণে জাইকার প্রতিনিধিরা বেশ বিরক্ত ছিলেন। তাদের আস্থাও কমে যাচ্ছিল। বিজয় সরণিতে মেট্রোর গতিপথ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল বিমানবাহিনী। তবে স্যার জোরালোভাবে বিশ্বাস করতেন, সবচেয়ে ভালো গতিপথ হওয়া উচিত ছিল, বিজয় সরণি দিয়ে আসা। তিনি ব্যাপারটা নিয়ে অনেক জোরালোভাবে কথাও বলেছেন। কিন্তু বিমানবাহিনীর আপত্তির মুখে সেটা শেষ পর্যন্ত করা সম্ভব হলো না। অন্যদিকে মেট্রোর বাংলামোটরের গতিপথটি ঠিক হয় স্যারের বাসায়। একইভাবে ওনার পরামর্শে সেটি সায়েদাবাদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মতিঝিলে সরিয়ে নেয়া হয়।

ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ২০১৬ সালে। নির্মাণপর্যায়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কারণে এর কিছুদিন পর একটি প্যানেল অব এক্সপার্টস দল গঠন করা হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবর প্যানেল অব এক্সপার্টস দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন জাতীয় অধ্যাপক . জামিলুর রেজা চৌধুরী। ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন দেশের খ্যাতনামা প্রকৌশলী।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন