মেট্রোরেল উদ্বোধন: আর মাত্র ৪ দিন

পুরোটাই উড়ালপথে নির্মাণ ভারতের ‘মেট্রো ম্যান’ শ্রীধরনের পরামর্শে

শামীম রাহমান

২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হবে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলের একাংশ। মেট্রোটির পরিকল্পনা নির্মাণ পর্যায়ে সম্পৃক্ত প্রকৌশলী, আনুষঙ্গিক অবকাঠামো এবং মেট্রোয় ভ্রমণের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে বণিক বার্তার ধারাবাহিক আয়োজনে আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব 

ঢাকার যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে ২০০৫ সালে একটি ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লুইস বার্জার গ্রুপ ইনকরপোরেশন। পরিকল্পনায়ই প্রথমবারের মতো মেট্রোরেল নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। ঢাকার জন্য তিনটি মেট্রো লাইনের একটি সম্ভাব্য রুটও চিহ্নিত করা হয় এসটিপিতে। রুটগুলোর একটি ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হতে যাওয়া (একাংশ) উত্তরা-মতিঝিল-কমলাপুর মেট্রো বা এমআরটি লাইন-৬। পুরোটাই উড়ালপথে তৈরি হচ্ছে ঢাকার প্রথম মেট্রো। যদিও প্রথমদিকে মেট্রোটির গতিপথ কিছুটা ভিন্ন ছিল। কিছু অংশ মাটির সমান্তরালে (অ্যাট গ্রেড), কিছু অংশ উড়ালপথে (এলিভেটেড) আর কিছু অংশ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল পাতালপথে (আন্ডারগ্রাউন্ড) তবে নকশা চূড়ান্ত করার আগে ঢাকার প্রথম মেট্রোর কাঠামো বদলে দেয় ভারতের মেট্রো ম্যান হিসেবে খ্যাত . শ্রীধরনের কিছু পরামর্শ। তার পরামর্শ ছিল, নির্মাণ পরিচালন ব্যয়ের কথা চিন্তা করে প্রথম মেট্রোটি পাতালপথে করা ঠিক হবে না। তিনি পুরো মেট্রোটি উড়ালপথে নির্মাণের পরামর্শ দেন।

উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা নকশা করেছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) এর মধ্যে ধারণাগত নকশার কাজ সম্পন্ন হয় ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর। আর বিস্তারিত নকশা তৈরির কাজ শেষ হয় ২০১৬ সালের আগস্টে।


নকশা চূড়ান্ত হওয়ার আগে একাধিকবার গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেট্রো প্রকল্পটির পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন (ইআইএ) প্রকাশ করে তত্কালীন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় বোর্ড বা ডিটিসিবি (বর্তমানে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ বা ডিটিসিএ) এতে মেট্রোরেলের জন্য নির্ধারিত রুট হিসেবে উত্তরা থেকে ফার্মগেট-শাহবাগ হয়ে কাপ্তানবাজার-সায়েদাবাদ এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়। অবশ্য সে বছরই রুটটি কিছুটা পরিবর্তন করে শাহবাগ থেকে সায়েদাবাদের বদলে মতিঝিল-কমলাপুরের পথে নিয়ে যায় তত্কালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়।

জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী, উত্তরার তিন কিলোমিটারে মেট্রো তৈরি হওয়ার কথা ছিল মাটির সমান্তরালে। সেখান থেকে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন পর্যন্ত উড়ালপথে। আর মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোটি পাতালপথ দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। মাঝের অংশটি উড়ালপথে নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছিল।

২০০৫ সালের এসটিপিতে সুপারিশের পর মেট্রোরেলের পরিকল্পনা নির্মাণের সব পর্যায় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক . সামছুল হক। পরিকল্পনার বিভিন্ন পর্যায়ে সরাসরি অংশও নিয়েছেন তিনি।

. সামছুল হক জানিয়েছেন, নকশা প্রণয়নের সময় জাইকার প্রকৌশলীরা উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মাটির সমান্তরালে নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পাতালপথে নির্মাণ করার কথা ছিল।

প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সম্ভবত ঘটনাটি ২০১২ সালের। জাইকার প্রকৌশলীরা উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোর নকশা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। অর্ধেক অংশ মাটির সমান্তরালে, আর অর্ধেক অংশ হবে মাটির নিচ দিয়ে। তবে নকশা চূড়ান্ত করার আগে আঞ্চলিক অভিজ্ঞতা নেয়ার একটা বিষয় ছিল। এজন্য ভারতের স্বনামধন্য মেট্রোরেল বিশেষজ্ঞ . শ্রীধরনকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানায় জাইকা। উদ্দেশ্য ছিল, তার কাছ থেকে ভারতীয় মেট্রোগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোর নকশা চূড়ান্ত করা।

তিনি (শ্রীধরন) প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে একটা প্রেজেন্টেশন দিলেন। সেখানে আমার থাকার সুযোগ হয়েছিল। জামিলুর স্যারও

(জামিলুর রেজা চৌধুরী) ছিলেন। প্রেজেন্টেশনে শ্রীধরন যা বলেছিলেন, তার মূল কথা ছিল, পাতাল মেট্রো নির্মাণ সেটি পরিচালনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আমরা ৮৪-তে বানিয়ে (কলকাতা মেট্রো, ভারতের প্রথম মেট্রো) ভুল করেছি। পরবর্তী সময়ে এক্সটেনশন লাইনটাও আন্ডারগ্রাউন্ড করিনি। যত কিছু বানাচ্ছি, হিস্টোরিক্যাল যদি কোনো কনস্ট্রেইন্ট না থাকে, তাহলে আমরা আন্ডারগ্রাউন্ডে যাই না। সেটা শ্বেতহস্তী হয়ে দাঁড়ায়। আন্ডারগ্রাউন্ড করতে গেলে তোমরা কখনো সেটা পপুলার করতে পারবা না। তখন জাইকা ইউটার্ন নেয়। ইউটার্ন নিয়ে পুরোটাই এলিভেটেড করে ফেলে।

২০০৯-১০ ২০১১-১২ সালে দুই দফা তত্কালীন ডিটিসিবির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ . সালেহ উদ্দিন। শ্রীধরন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এসটিপিতে তিনটি মেট্রোরেল নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে জাইকার সমীক্ষায় নম্বর--কে (উত্তরা-মতিঝিল) যাত্রীদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক হিসেবে তুলে ধরা হয় এবং মেট্রোটি সবার আগে নির্মাণের পরামর্শ দেয়া হয়। তখন শ্রীধরন নামের এক ভদ্রলোককে জাইকা আমন্ত্রণ জানিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে। রুটটি নির্মাণে শ্রীধরন গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন।

শ্রীধরনের পুরো নাম ইলাত্তুভালাপিল শ্রীধরন। জন্ম ১৯৩০ সালের ১২ জুন, ভারতের কেরালায়। পেশায় প্রকৌশলী শ্রীধরন ভারতের মেট্রো ম্যান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। ১৯৮৪ সালে ভারতের প্রথম মেট্রোরেল তৈরি হয় কলকাতায়। মেট্রোটি নির্মাণে নেপথ্য ভূমিকা ছিল তার। তার হাত ধরেই দেশটির কোচি, লক্ষে জয়পুরে মেট্রো প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রীধরনের সম্পৃক্ততা ছিল মহারাষ্ট্রের কোঙ্কন রেলওয়ে প্রকল্পেও। রেলওয়ের বাইরে ভারতে প্রথম সমুদ্র সেতু তামিলনাড়ুর পাম্বান সেতু নির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন শ্রীধরন। ৯০ বছর বয়সী প্রকৌশলী পেশাগত জীবনে সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন দিল্লি মেট্রোর প্রধান হিসেবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন