ডালশস্যে আমদানিনির্ভরতা কাটাতে পারছে না বাংলাদেশ

শাহাদাত বিপ্লব

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলা হলেও দেশে উৎপাদন কেন্দ্রীভূত প্রধানত চাল আলুতে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ হয় ডালের মাধ্যমে। তবে ডালের ক্ষেত্রে এখনো আমদানিনির্ভর বাংলাদেশ। প্রতি বছর মোট চাহিদার ৭০-৭৫ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। ফলে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ বছরে আমদানির পরিমাণ ব্যয় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে ডাল উৎপাদনের সঠিক তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে না সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে। উৎপাদন নিয়ে মূলত পরিসংখ্যান করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। উৎপাদনের পরিসংখ্যান নিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের তথ্যে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে। ডালশস্যের ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মোট উৎপাদনের পরিমাণ পরিসংখ্যান ব্যুরোর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ফলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ব্যবহার করা যাচ্ছে না সঠিক তথ্যও।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, পাঁচ বছরের ব্যবধানে ডালশস্য আমদানি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন ডালজাতীয় শস্য আমদানি হয়েছে লাখ ৮১ হাজার ১৬৭ টন। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ডালজাতীয় শস্য আমদানি করা হয়েছে ১৭ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৮ টন। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ লাখ ১৬ হাজার ৭০৭ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৬ লাখ ৪৭ হাজার ৪৫১ টন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১ লাখ হাজার ৫১৮ টন ডালজাতীয় শস্য আমদানি করতে হয়েছে। আমদানীকৃত ডালশস্যের অর্ধেকই মসুর ডাল ছোলা। ২০২১-২২ অর্থবছরে লাখ ৩৬ হাজার ৬৩০ টন মসুর ডাল এবং লাখ ৭৬ হাজার ৮০৫ টন ছোলা আমদানি করতে হয়েছে। এছাড়া মুগডাল, মটর, মাষকলাই, ডানপিস, ইয়েলোপিস, গ্রিন পিচ, ফেলন, তিসি, কিডনি বিনসহ বিভিন্ন ধরনের ডালজাতীয় শস্য আমদানি করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে হাজার ৩৪৯ কোটি টাকার ডালশস্য আমদানি করা হয়। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা ২০২০-২১ অর্থবছরে হাজার ৫৭৬ কোটি টাকার ডালশস্য আমদানি করা হয়েছে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে হাজার ১৮৫ কোটি টাকার ডালশস্য আমদানির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে আমদানি ব্যয়ও প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।

চলতি বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে দেশে ডালশস্যের চাহিদা ছিল ১৬ লাখ ১১ হাজার টন। এর বিপরীতে দেশে উৎপাদিত ডালজাতীয় শস্যের জোগান ছিল লাখ ৯৯ হাজার টন। ঘাটতি ১২ লাখ ১২ হাজার টনের। অর্থাৎ দেশে উৎপাদিত ডাল দিয়ে মাত্র ২৪ দশমিক শতাংশ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। আর বাকি ৭৫ দশমিক শতাংশই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। এছাড়া দেশে ডালশস্যের চাহিদা ২০৩০ সাল নাগাদ ১৭ লাখ ৯০ হাজার টনে দাঁড়াবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়।

এদিকে দেশে ডালশস্যের মোট উৎপাদন নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে বিস্তর ফারাক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে লাখ ৯১ হাজার হেক্টর জমিতে লাখ ৩১ হাজার টন ডালজাতীয় শস্য উৎপাদন হয়। আবার পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী একই অর্থবছরে লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে লাখ ২৪ হাজার টন ডালশস্য উৎপাদন হয়। অর্থাৎ পরিসংখ্যান ব্যুরোর চেয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যে উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ দেখানো হয়েছে। একই চিত্র এর আগের বছরগুলোর তথ্যেও।

কৃষি সম্প্রসারণের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ৬৪ হাজার টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে লাখ ৩৭ হাজার টন ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লাখ ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ৩৮ হাজার টন ডালশস্য উৎপাদন হয়। আবার পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর জমিতে লাখ ৯৭ হাজার টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে লাখ ৯৩ হাজার টন ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে লাখ ৮৯ হাজার টন ডালশস্য উৎপাদন হয়। দেশে উৎপাদিত ডালশস্যের মধ্যে রয়েছে ছোলা, অড়হড়, মসুর, মুগ, মাষকলাই, খেসারি, ফেলন গাড়িকলাই।

বর্তমানে ডলারের উচ্চমূল্যে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণপত্র খুলতে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে দেশের চাহিদামাফিক উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অতি আমদানিনির্ভরতা কাটাতে উচ্চফলনশীন জাত উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করতে হবে।

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান . রিপন কুমার মণ্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে উৎপাদন চাহিদার প্রকৃত চিত্র নিয়ে এক ধরনের ধাঁধার মধ্যে থাকতে হয়। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে চিন্তা থেকে তথ্য দেয়া হয় অনেক সময়। ফলে পরিসংখ্যান ব্যুারো ডিএইর তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের ফারাক থাকে। অথচ দুটোই সরকারি তথ্য। মানুষ কোন তথ্য গ্রহণ করবে তা নিয়ে দ্বিধায় থাকতে হয়। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সঠিক তথ্য না থাকলে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। এক্ষেত্রে তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

ডালজাতীয় শস্যের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, কৃষি বিভাগ, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন এসব জাতকে প্রমোট করা। কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে হলেও উৎপাদনে আগ্রহী করে তুলতে হবে। অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকলে যেকোনো সময় সংকটে পড়তে হয়। যেটা এখন হচ্ছে। ডাল আমদানি করতে ডলার লাগে। ডলার সংকট হলে তখন দাম বেড়ে যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, তথ্যে গরমিল হওয়ার কারণ আছে। লোকবল সংকট। আর বিবিএস উপজেলা লেভেলে জনবল অনেক কম। তাদেরটাও যে বিশ্বাস করা যাবে বিষয়টা এমন নয়। আবার ডিএইর তথ্যও অ্যাকুরেট না। অনেকে উপজেলা পর্যায় থেকে টেবিল ওয়ার্ক করে পাঠায়। তথ্যগুলো সুস্পষ্ট হওয়া উচিত।

বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের যা তথ্য তা শতভাগ না হলেও প্রায় শতভাগ সঠিক। মাঠ পর্যায়ে প্রতিটি ইউনিয়নে আমাদের তিনজন করে জনবল আছে। প্রতি উপজেলায় ৩০-৬০ জন কাজ করে। তাদের কাজ হলো মাঠ ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা। তারা ৩০-৪০ বছর ধরে একই জিনিস দেখে। সুতরাং এটাকে সঠিক বলা যায়। আর বিবিএসে প্রতি উপজেলায় মাত্র একজন। এই একজনকে কৃষি ছাড়াও অন্য সব বিষয়ে কাজ করতে হয়। সুতরাং আমাদের তথ্য আমরা সঠিক বলে মনে করি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন