মাধ্যমিকে গণিত ও ইংরেজি শিক্ষকের ৮০ শতাংশই ভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রিধারী

বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রিধারীদের প্রাধান্য দেয়া হোক

মানসম্পন্ন দক্ষ শিক্ষকের অভাব ক্রমে প্রকট আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশে। গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি থেকে শুরু করে অনেক বিষয়ে পাঠদানের মতো দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থীর ভিত্তি দুর্বল থেকে যাওয়ায় উচ্চশিক্ষায় তার প্রভাব পড়ছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে ব্যানবেইসের গবেষণা তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত ইংরেজি বিষয়ে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকের ৮০ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো ডিগ্রি নেই। এদের বড় অংশেরই ইংরেজি গণিত বিষয়ে পড়াশোনা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। শিক্ষকদের যোগ্যতাগত ঘাটতির প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের শিখনফলে। শিক্ষকতা শুরুর পর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও নেই অনেকের। ফলে দক্ষ শিক্ষকের অভাবে ইংরেজি গণিতে শিক্ষার্থীদের ভালো ভিত গড়ে উঠছে না। একই কথা বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিদ্যমান বাস্তবতায় শিক্ষার মানোন্নয়নে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চ ডিগ্রির অধিকারী মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। সব শিক্ষকের জন্য বুনিয়াদি বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কর্মরত শিক্ষকদের জন্য কর্মকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং একই সঙ্গে শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করতে অবশ্যই যথোপযুক্ত বেতন-ভাতা দিয়ে তাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা পেশাগত স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার প্রদান জরুরি।

উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ভিত্তি তৈরির ক্ষেত্র হিসেবে ধরা হয় মাধ্যমিক শিক্ষাকে। এখানেই একজন শিক্ষার্থীর বিষয়ভিত্তিক প্রাথমিক জ্ঞান তৈরি হয়। ফলে এখানে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক দেয়া জরুরি। কোন শিক্ষক কোন বিষয়ে পাঠদান করবেন, সাধারণত তা নির্ধারণ করে দেন প্রধান শিক্ষক। এক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদারকি নিয়ম প্রণয়নের মাধ্যমে এর মান বজায় রাখতে উদ্যোগী হতে পারে। গণিতের ডিগ্রিধারীদের গণিতের পাঠদান, ইংরেজি ডিগ্রিধারীদের ইংরেজির পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের পাঠদান দক্ষতাও বাড়িয়ে তুলতে হবে নিয়মিত বিরতিতে। প্রত্যাশা থাকবে, শিক্ষক নিয়োগের নিয়মাবলি নির্দিষ্টপূর্বক দ্রুতই গাইডলাইন প্রণয়ন করবে সরকার। এটি বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারিও রাখবে। দেশের অধিকাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হওয়ায় আর্থিক সংকটের কারণে পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষকের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত সরকারেরই। মাধ্যমিক শিক্ষায় ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। আবার শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারায় মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হারও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

গুণগত শিক্ষার অনেক অপরিহার্য পূর্বশর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে অধিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। কথাও অনস্বীকার্য, বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নে বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু সুচারুভাবে খরচ করা হয় না, যা অনভিপ্রেত অনাকাঙ্ক্ষিত। দেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের বর্তমান বরাদ্দ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে যেমন শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি, তেমনি শিক্ষকদের কার্যকর প্রশিক্ষণের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। আসলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার যে গলদ সেটা শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় এসে এর প্রভাব পড়ে। সার্কভুক্ত ভারত, শ্রীলংকা এবং উন্নত দেশের মতো শিক্ষকদের সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণ, মেয়াদি-বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণে সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। মর্মে একটি নীতিমালা বা পরিপত্র জারি করা প্রয়োজন যে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সব শিক্ষককে পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে।

বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক মাধ্যমিকে সব বিষয়ে না থাকা একটি বাস্তবতা। এর জন্য এককভাবে কেউ দায়ী নয়। তবে বেশির ভাগ শিক্ষকই ইংরেজি, গণিত বিষয়ে পাঠদান করতে চান প্রাইভেট টিউশনির জন্য। আর এজন্য কর্তৃপক্ষের আনুকূল্য পেতে হয়। আর একটি সমস্যা হচ্ছে গ্রামীণ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষকের এমনিতেই ঘাটতি রয়েছে, তারপর বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক থাকার তো প্রশ্নই আসে না। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় রয়েছে ভিন্ন সমস্যা। ঢাকা সিটিসহ দেশের বড় বড় শহরে এবং অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অঞ্চলে অবস্থিত সরকারি বিদ্যালয়গুলোয় রয়েছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিক্ষক আর গ্রামীণ এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় খুব কমসংখ্যক শিক্ষক। তার পরও খোদ রাজধানীর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক ধরন অনুসারে শিক্ষক পদায়ন করা নেই। এসব বিদ্যালয়ে এক বিষয়ের শিক্ষক আরেক বিষয়ের ক্লাস নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এখানে নতুন কারিকুলাম কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সন্দিহান খোদ শিক্ষকরাই। নতুন কারিকুলামে প্রশিক্ষণবিহীন কোনো শিক্ষক আগামী ৩১ ডিসেম্বরের পর আর ক্লাস নিতে পারবেন না। ডিসেম্বরের আগেই ঢাকার স্কুলগুলোর শিক্ষকদের বিষয় সমন্বয় করে ফেলা হবে বলে মন্তব্য করেছেন মাউশিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিদ্যমান শিক্ষকদের সফটওয়্যারের মাধ্যমে সমন্বয় করাতে প্রধান শিক্ষকদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে মোট ১০টি বিষয় থাকছে। এর আলোকে বর্তমানে বিষয়ভিত্তিক পদে কর্মরত শিক্ষকদের বিষয় নির্ধারণ করে সেপ্টেম্বর ১০-এর মধ্যে ইএমআইএস ডাটাবেজ হালনাগাদ করতে বলা হয়েছিল, তারিখ আবার বর্ধিত করা হয়েছে। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে সারা দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়, মাদরাসা কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ষষ্ঠ সপ্তম শ্রেণীতে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-এর আলোকে প্রণীত শিক্ষাক্রম এবং পাঠপুস্তকের সাহায্যে শিখন কার্যক্রম চালু হতে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রশিক্ষণ প্রদানের আগে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদানরত শিক্ষকদের বিষয় নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

সরকার এতদিন শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নে মনোযোগী ছিল। খাতে বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এখন শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর অংশ হিসেবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। যেসব শিক্ষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি নেই, তাদের দিয়ে পাঠদানে কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জন সম্ভব নয়। শুধু গণিত কিংবা ইংরেজি নয়, বিজ্ঞানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ডিগ্রিধারীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া জরুরি। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ দেয়া হলেও এর আগের অনেক শিক্ষক এখনো পাঠদানে নিয়োজিত, যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ। এসব জায়গায় সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি সঠিক পরিকল্পনা করে সেগুলোর বাস্তবায়ন করা উচিত।

দেশের শিক্ষায় যে বহুমাত্রিক সংকট চলছে, শিক্ষকস্বল্পতা তার মধ্যে একটি। কী সরকারি, কী বেসরকারি প্রায় সর্বত্র একই অবস্থা। আর মাধ্যমিক পর্যায়ে এখনো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সেভাবে পাওয়া যায় না। বিজ্ঞান ইংরেজির শিক্ষকস্বল্পতা এখনো বিরাজ করছে। সরাসরি বিজ্ঞান ইংরেজির শিক্ষক পাওয়া না গেলে যেসব শিক্ষকের এসব বিষয়ে আগ্রহ আছে, তাদের একটি লেভেল টেস্ট নিয়ে বিষয়ভিত্তিক বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে সমস্যার কিছুটা সমাধান সম্ভব। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মান আরো বাড়ানো উচিত। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। শিক্ষকদের প্রযুক্তিবান্ধব হিসেবে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। নীতিনির্ধারকদের প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার শতভাগ মান নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্ব দিতে হবে। বিদ্যালয় পরিচালনায় দায়সারা গোছের কমিটি নয়, সমাজের সক্রিয় ব্যক্তিদের এতে সম্পৃক্ত করতে হবে। নিয়মিত তদারকি সভার মাধ্যমে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে গতিশীল করে তুলতে হবে। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি, অভিভাবক কমিটি, ইউনিয়ন পরিষদের স্থায়ী কমিটি উপজেলা শিক্ষা অফিসের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন