আইপিএস : জো বাইডেন যেখানে অন্ধ

বণিক বার্তা অনলাইন

বাইডেন প্রশাসনের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস) গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জানায়, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ‘সম্মিলিত ও পারস্পারিকভাবে শক্তিশালী জোটের জাল’ হিসেবে কাজ করবে আইপিএস।

সে লক্ষ্যে ওয়াশিংটন এ অঞ্চলে বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। মার্কিন প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে রয়েছে কোয়াড। এটি একটি চতুর্পাক্ষিক সংলাপ প্রক্রিয়া। জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে এ জোটে একত্রিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া রয়েছে নিরাপত্তা চুক্তি অকাস, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এই জোটে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ওয়াশিংটন অনেক দেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব করেছে। যার মধ্যে রয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ), কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রগ্রেসিফ ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এবং রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিফ ইকোনমিক পার্টনারশিপ।

এ ছাড়া বাইডেন প্রশাসন ভারত-প্রশান্ত অঞ্চলে জি৭-কে সঙ্গে নিয়ে অবকাঠামাগত বিনিয়োগ কর্মসূচি বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড (বিথ্রিডব্লিউ) পার্টনারশিপ গঠন করেছে।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন উদ্যোগগুলোর মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের দেশগুলোর সঙ্গে ইউএস-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ রয়েছে। ‘পার্টনারস ইন দ্য ব্লু প্যাসিফিক (পিবিপি)’ নামে গত জুনে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যকে অন্তর্ভূক্ত করে একটি পরিপূরক উদ্যোগও নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন এ সব গ্রুপ ও নেটওয়ার্কের সঙ্গে আঞ্চলিক ফোরাম আসিয়ান ও ইস্ট এশিয়া সামিটে ওয়াশিংটনের দীর্ঘস্থায়ী অংশগ্রহণের স্বার্থ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বহুপাক্ষিক এই সম্পৃক্ততা ধনী দেশগুলোর জন্য বিব্রতকর হবে। ওয়াশিংটনের এ প্রচেষ্টা কয়েকটি চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ও প্রতিশ্রুতি এ অঞ্চলে কিছু দেশের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করলেও একটু গলদ রয়েছে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডা বা প্রাধান্য দেয়ার বিষয় কী, তা স্পষ্ট নয়। অনেক দেশ মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক উদ্বেগ ও জলবায়ু পরিবর্তনে নিরাপত্তা ইস্যুতে মনোযোগ দিচ্ছে।

ওয়াশিংটনের ভিন্নমুখী অগ্রাধিকার বা জোটের উদ্দেশ্য হলো চীনকে মোকাবিলা করা। সে জন্য এ অঞ্চলের অনেক নেতা ও কৌশলগত চিন্তাবিদরা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটি পক্ষ বেছে নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে।

ওয়াশিংটন বারবার জোর দিয়ে বলেছে, তার মিত্র বা অংশীদারদের ওপর এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে না। তবে তাদের কিছু কূটনীতি ও বাগাড়ম্বর সিদ্ধান্ত তাদের দলভূক্ত হওয়ার সিদ্ধান্তকেই চাপিয়ে দেয়।

কয়েকজন মার্কিন অংশীদারও উদ্বিগ্ন কীভাবে একাধিক উদ্যোগ একত্রে খাপ খায়। আসিয়ান দেশগুলো অনেক আগে থেকেই আঞ্চলিক বহুপাক্ষিকতায় ওয়াশিংটনের ‘আসিয়ান কেন্দ্রিকতা’ নীতিকে স্বাগত জানিয়ে আসছে।

কিন্তু কোয়াড ও অকাস থেকে আসিয়ানকে বাদ দেয়ায় প্রশ্ন উঠছে, মার্কিন মনোযোগ আসলে কোথায়? তাহলে কি চীন ও অন্য আঞ্চলিক সমস্যা মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়া থেকে মার্কিন মনোযোগ সরছে?

এদিকে কোয়াড গতি লাভ করছে। এর কার্যকারিতা বা লক্ষ্য কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে আলোচনা বা ঐকমত্য থাকতে হবে। কোয়াডের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন হবে এবং চীনের সঙ্গে কতটা দ্বন্দ্বমূলক তা স্পষ্ট করতে হবে। সদস্যদের প্রতি একে অপরের আস্থার তারতম্য হলে কোয়াড বাধাগ্রস্ত হবে।

সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক আস্থাও একটি দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। ২০১৭ সালে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ থেকে ওয়াশিংটনের বেরিয়ে যাওয়া এই অঞ্চলে তার প্রতিশ্রুতি ক্ষুণ্ন হয়েছে। আর বিকল্প হিসেবে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক অনেকে সামান্য হিসেবে দেখেছে। এ অঞ্চলের অনেকের ধারণা, মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অদূর ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের নির্ভরযোগ্যতাকে সীমাবদ্ধ করবে।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ‘হাতি’ হলো চীন। তা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুপাক্ষিক উদ্যোগ থেকে বাদ পড়েছে চীন। ওয়াশিংটন ও এর মূল অংশীদাররা বহুপাক্ষিক কূটনীতিতে চীনকে তোয়াক্কা করে না। কোয়াড, অকাস, আইপিইএফ, বিথ্রিডব্লিউ ও ‘পার্টনার্স ইন দ্য ইন্দো-প্যাসিফিক’ যে চীনকে ঠেকানোর লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এ অঞ্চলে ওয়াশিংটনের বহুপাক্ষিক কূটনীতি প্রায়শই অবাধ, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল গড়ার ওপর জোর দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক উদ্যোগে চীনকে যুক্ত করতে চায় না এবং তাদের লক্ষ্যবস্তুতে চীন আসে।

বৃহৎ শক্তিশালী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট ও চীনকে বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এটি আইপিএসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত। দুদেশই স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি, পারস্পরিক সুবিধা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য আঞ্চলিক বহুপাক্ষিকতায় মূল ভূমিকা পালন করছে।

আশঙ্কা হলো, বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে অনিবার্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং কৌশলগত অবিশ্বাসের কারণে সহযোগিতা জটিল হবে। তবে প্রতিকূল শিবিরের মধ্যে বিভক্ত একটি অঞ্চলের বিকল্প অবশ্যই খারাপ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে এমন একটি নিরাপত্তা পদ্ধতি বিবেচনা করা, যেন সেটি চীনের বিরুদ্ধে একচেটিয়াভাবে কাজ না করে।

লেখক: পল হিয়ার, সেন্টার ফর দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের ফেলো।

সূত্র: ইস্ট এশিয়া ফোরাম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন