স্বাধীনতা-পরবর্তী গত পাঁচ দশকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কী পরিমাণ পাহাড় কাটা হয়েছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে। এতে পাহাড় ব্যবস্থাপনা নিয়ে করণীয় কী সে বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় সংস্থাগুলো। চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণে সম্প্রতি নকশা প্রণয়ন ও কনটুর জরিপের প্রস্তাব দিয়েছে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হলে চট্টগ্রাম জেলার পাহাড় এলাকার নকশা প্রণয়ন এবং কী পরিমাণ পাহাড় চট্টগ্রামে আছে, তার বিস্তারিত তথ্যের ডাটাবেজ তৈরি করা সম্ভব হবে। তবে পাহাড় নিয়ে জরিপের কাজটি বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। পরিবেশ অধিদপ্তরও মনে করছে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য রক্ষণাবেক্ষণে বড় ভূমিকা রাখা যাবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘চট্টগ্রাম জেলার পাহাড় ও টিলাগুলোর কনটুর (সীমানসূচক রেখার জরিপ) এবং সীমানা’ শীর্ষক একটি প্রস্তাব পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয় থেকে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটিতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামে যেখানে পাহাড় আছে, সেই এলাকা চিহ্নিতকরণ ও পাহাড়ি এলাকার নকশা প্রণয়ন, পাহাড়ের শ্রেণী নির্ধারণ, পাহাড় বা টিলাগুলোর উচ্চতা নিশ্চিত করা, পাহাড়ের জমির মালিকানা চিহ্নিতকরণ, কতটুকু পাহাড় কাটা হয়েছে সেটি সম্পর্কে তথ্য রেকর্ডে রাখা, দখলদারদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন, পাহাড় কাটলে সেখানে কত উচ্চতার পাহাড় আগে ছিল সে বিষয় চিহ্নিত করা সম্ভব হবে প্রকল্পের মাধ্যমে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এ জরিপটি পাহাড় ব্যবস্থাপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। কেননা কী পরিমাণ পাহাড় এ চট্টগ্রামে আছে কিংবা কতটি পাহাড় কাটা হয়েছে, কারা দখল করে রেখেছে, ভূমি শ্রেণীতে পাহাড়ের অবস্থান পরিবর্তন করা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে নেই। যার কারণে কোনো পাহাড় কাটা হলে সেখানে পাহাড়ের পরিমাণ আগে কতটুকু ছিল সেটা না জানার কারণে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এ প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রামের পাহাড়ের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করা সম্ভব হবে।
প্রকল্পটির জন্য প্রাথমিক বাজেট ৭৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব না বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, প্রকল্পটির গুরুত্ব বিবেচনা করে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগরে পাহাড় কাটার ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৩৫টি। এর মধ্যে পাহাড় কাটার অপরাধে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে প্রায় ৬০টি। যার বেশির ভাগ মামলা চার্জশিট এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে রায় দিতে পারেননি পরিবেশ আদালত। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গোপন সংবাদ এবং অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রায় ৯০টির বেশি অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে এ পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলার রায়ের হার গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশের কম।
প্রকল্পটি সম্পর্কে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের (জেলা) উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বণিক বার্তাকে বলেন, পরিবেশ আইনে পাহাড় কাটলে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে। তবে পাহাড় রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে তেমন কোনো নির্দেশনা না থাকায় পাহাড় রক্ষায় আমাদের করণীয় কী সে বিষয়ে কোনো সুপারিশ নেই। যার কারণে এ চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয় চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষায় বিশেষায়িত জরিপ করার উদ্যোগ নিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
তিনি জানান, আমরা একটি প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছি। এতে চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়ের সংখ্যা, অবস্থান, পাহাড়ের উচ্চতা, শ্রেণী, জমির পরিমাণ ইত্যাদি বিষয় রাখা হয়েছে। প্রাথমিক প্রস্তাব অনুমোদন হলে আমরা বিস্তারিত প্রস্তাবনা সরকারের কাছে উপস্থাপন করব। এ প্রকল্পটি অনুমোদন হলে চট্টগ্রামের পাহাড়ের হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৮৮টি পাহাড় একেবারেই হারিয়ে গিয়েছে। প্রায় ৯৫টি পাহাড় আংশিকভাবে কাটা হয়েছে। তবে কোনো গবেষণা জরিপ না থাকায় গত ১৪ বছরে কী পরিমাণ পাহাড় কাটা হয়েছে, তার কোনো তথ্য নেই পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা অন্য কোনো সংস্থার কাছে।
গবেষকরা বলছেন, চট্টগ্রামের চট্টগ্রামের বায়েজিদ লিংক রোড এবং জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় সরকারি যে ৩ হাজার ১০০ একর খাস জমি দখল করা হয়েছে, সেখানে অনেক পাহাড় কেটে প্লট বানিয়ে বিক্রি করেছে দুষ্কৃতকারীরা। ঠিক কী পরিমাণ পাহাড় সেখান থেকে কাটা হয়েছে, তার হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে বায়েজিদ লিংক রোড এলাকায় প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রায় ১৫টির বেশি বড় পাহাড় কাটা হয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় সড়ক নির্মাণের অজুহাতে অনেক পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে।
পরিবেশবিদ ড. ইদ্রিস আলী বণিক বার্তাকে বলেন, চট্টগ্রামের সৌন্দর্য ধারণ করে প্রাকৃতিক পাহাড়গুলো। কিন্তু এ সৌন্দর্য হারিয়ে যেতে বসেছে বাছবিচারহীনভাবে পাহাড় কাটার কারণে। সরকারি থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে দখল করে পাহাড় কাটা হচ্ছে। চট্টগ্রাম ক্রমেই পাহাড়শূন্য এলাকা হয়ে পড়ছে। জেলা প্রশাসন থেকে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির যে সুপারিশ দেয়া হয়েছে, গত এক যুগে তার একটি প্রস্তাবও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা ও জরিমানা করেই তাদের দায় সারছে। কিন্তু পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদ। পাহাড় কাটলে তাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাহাড় সংরক্ষণ ও গণনায় যে জরিপের মাধ্যমে ডাটাবেজ তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা অত্যন্ত জরুরি।