গ্যাসের ৮২% মজুদ নিয়েও বিনিয়োগের অভাবে দেশী কোম্পানির জোগান বাড়ছে না

আবু তাহের

দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় গ্যাসের মজুদ রয়েছে সাড়ে ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে পাঁচটি কোম্পানি। এর মধ্যে স্থানীয় কোম্পানি তিনটি। দুটি কোম্পানি বিদেশী। দেশের মোট মজুদকৃত গ্যাসের ৮২ শতাংশেরও বেশি রয়েছে স্থানীয় কোম্পানি তিনটির আওতাধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলোয়। যদিও জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের দৈনিক স্থানীয় সরবরাহের মাত্র ৩৭ শতাংশ দিতে পারছে কোম্পানি তিনটি।

দেশে গ্যাস উত্তোলন সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত তিনটি কোম্পানিই পেট্রোবাংলার অধীন। এগুলো হলো বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) এর মধ্যে বাপেক্স গ্যাস উত্তোলনের পাশাপাশি অনুসন্ধানের কাজও চালিয়ে থাকে। কোম্পানি তিনটির অধীন গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা ১৬টি। গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় গ্যাসের মোট মজুদ রয়েছে টিসিএফের মতো, যা মোট মজুদের ৮২ শতাংশেরও বেশি।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গত মাসের শেষে দেশে দৈনিক গ্যাস উত্তোলন ছিল হাজার ৩০৭ দশমিক মিলিয়ন ঘনফুট (এমসিএফ) এর মধ্যে পেট্রোবাংলার অধীন দেশী কোম্পানিগুলো উত্তোলন করেছে ৮৫৪ দশমিক এমসিএফ, যা দৈনিক মোট স্থানীয় গ্যাস সরবরাহের মাত্র ৩৭ শতাংশ।

গ্যাস মজুদের সিংহভাগের দখল থাকলেও সরবরাহের ক্ষেত্রে পিছিয়ে দেশী কোম্পানিগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশী কোম্পানিগুলোর আওতাধীন গ্যাসক্ষেত্রে স্থাপিত কূপগুলো অনেকদিনের পুরনো। এগুলোর সংস্কার হয়নি দীর্ঘদিন ধরে। কূপগুলোর সংস্কারের পাশাপাশি উত্তোলন সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগও পাচ্ছে না কোম্পানিগুলো। এতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর সরবরাহে তেমন একটা তারতম্য না এলেও স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা সরবরাহ দুটোই কমেছে।

বিদেশী কোম্পানি শেভরন তাল্লোর আওতাধীন গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে চারটি। গত মাসের শেষে এগুলো থেকে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ ছিল হাজার ৪৫২ দশমিক এমসিএফ, যা মোট স্থানীয় গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৬৩ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে এসব গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহে খুব একট কমবেশি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উত্তোলন স্বাভাবিক পর্যায়ে ধরে রাখতে কোম্পানিগুলো যথাসময়ে বিনিয়োগ করেছে। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে কম্প্রেসার স্থাপন করছে শেভরন। গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়ন কার্যক্রমেও নিয়মিত বিনিয়োগ চালিয়ে গিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিটি। আবার কোম্পানিটির বিরুদ্ধে সক্ষমতার অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলনের অভিযোগও রয়েছে।

জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শেভরন পাঁচ বছর ধরে গ্যাস উত্পাদন সক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে ধরে রেখেছে। এজন্য গ্যাসকূপগুলোয় সময়মতো নতুন কম্প্রেসারও বসিয়েছে। এতে তাদের গ্যাস উত্পাদনে খুব বেশি তারতম্য হয়নি।

দেশে বেশ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ তুলনামূলক বেশি হলেও এগুলো থেকে জ্বালানি পণ্যটির উত্তোলন হচ্ছে অনেক কম। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী, গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় স্থাপিত কূপের উন্নয়ন করা গেলে দেশে চলমান গ্যাসের সংকট স্থানীয় উত্তোলন দিয়েই অনেকটা পূরণ করা যেত। একই সঙ্গে এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে যেত।

দেশের বড় একটি গ্যাসক্ষেত্র তিতাস। ২৬টি কূপের মাধ্যমে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে বিজিএফসিএল। পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখানে গ্যাসের মজুদ রয়েছে হাজার ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুটের (বিসিএফ) মতো। এখানে গত মাসের শেষে দৈনিক উত্তোলন ছিল ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি। অন্যদিকে শেভরনের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ হাজার ২০০ বিসিএফ। এর বিপরীতে ওই সময় এখান থেকে সরবরাহ ছিল হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

দেশের অন্যান্য বড় গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে কৈলাসটিলা গ্যাসফিল্ডে গ্যাসের মজুদ রয়েছে হাজার বিসিএফ। কৈলাসটিলা - একটি কৈলাসটিলা - তিনটি কূপের মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম চালাচ্ছে এসজিএফএল। এই দুই গ্যাসক্ষেত্রের সম্মিলিত সরবরাহ ছিল ৩০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু কম।

এছাড়া বাপেক্সের অধীন শাহবাজপুর গ্যাসফিল্ডে ৫৪৩ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ রয়েছে। এখানে স্থাপিত কূপের সংখ্যা চারটি। গত মাসের শেষে এখানে দৈনিক উত্তোলিত গ্যাসের পরিমাণ ছিল ৬১ দশমিক মিলিয়ন ঘনফুট।

গত পাঁচ বছরে দেশী কোম্পানিগুলোর আওতাধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলোর দৈনিক উত্তোলন ধারাবাহিকভাবে কমেছে বলে জানিয়েছেন জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা। কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা ধরে রাখতে সময়মতো বিনিয়োগের পাশাপাশি যথাযথ কোনো পদক্ষেপও নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাদের।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক . তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, গত পাঁচ বছরে দেশীয় কোম্পানিগুলোর আওতায় থাকা কূপগুলো থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন কমেছে। গ্যাসকূপগুলো বহু পুরনো। উত্পাদন কমে গেলে কূপগুলোয় কম্প্রেসার বসিয়ে গ্যাসের প্রেসার বাড়াতে হয়। কিন্তু তা করা হয়নি। তাছাড়া এটি অনেক ব্যয়বহুল। এজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনতে হয়। গ্যাস সরবরাহের গুরুত্ব বিবেচনায় এটি অনেক আগেই করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটি দেশী কোম্পানিগুলো করতে পারেনি। অথচ দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী কোম্পানি শেভরন সেটি অনেক আগেই করেছে। ফলে বিবিয়ানার গ্যাস উত্পাদনও আগের মতো রয়েছে।

বর্তমানে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উন্নয়ন গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধিতে তিন বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচি চলমান রয়েছে বলে জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। এর আওতায় ২০২৩ সালের মধ্যে পাঁচটি অনুসন্ধান আটটি উন্নয়ন কূপ খননের কথা রয়েছে। এছাড়া ১০টি কূপের ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এসব খনন ওয়ার্কওভার কার্যক্রম শেষ হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক আরো ২৫০-৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রের উত্পাদন বাড়াতে আমরা গ্যাসকূপে কম্প্রেসার বসানোর উদ্যোগ নিয়েছি। একই সঙ্গে পুরনো পরিত্যক্ত কূপ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এসব প্রকল্পের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। বাপেক্স পুরনো কূপের কাজ করতে গিয়ে গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে। এটি করা গেলে দেশের গ্যাস সংকট সমাধানে নতুন পথ হতে পারে।

বাপেক্সের আওতাধীন গ্যাসক্ষেত্র আটটি। বর্তমানে এর মধ্যে ছয়টি গ্যাসক্ষেত্র উত্পাদনে রয়েছে। কোম্পানিটির মোট দৈনিক সরবরাহ সক্ষমতা ১৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিটির দুটি গ্যাসক্ষেত্র শাহবাজপুর সেমুতাংয়ে প্রায় ৮৫০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ রয়েছে। কূপের উন্নয়ন গ্যাস উত্পাদন বাড়াতে যথাযথ পাইপলাইন নির্মাণ করা গেলে দৈনিক আরো অন্তত ১০০-২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছে কোম্পানিটি।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, গ্যাসকূপের উন্নয়নে বড় বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। আমরা গ্যাসকূপ খননের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন কূপ খনন করছি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্যাসকূপ থেকে সুসংবাদও পাচ্ছি। তবে মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না। এখনো তা পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। আমরা ধারণা করছি, দেশে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি নিয়ে শিগগিরই নতুন সুসংবাদ আসতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন