বাংলাদেশকে বৈদেশিক সহায়তা প্রদান

শীর্ষ পাঁচের তালিকায় রাশিয়া ও চীন

সাইদ শাহীন

বৈদেশিক সহায়তাপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ মূলত বিশ্বব্যাংক, জাপান এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ওপর নির্ভরশীল। এর বাইরে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জাতিসংঘের মাধ্যমেও সহায়তা এসেছে। সম্প্রতি শীর্ষ সহায়তাকারী দেশের তালিকায় যুক্ত হয়েছে রাশিয়া চীন। বৈদেশিক সহায়তার তালিকা করলে দুটি দেশ থাকবে যথাক্রমে চতুর্থ পঞ্চম স্থানে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষ দেশ হিসেবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাপানের বৈদেশিক অর্থায়ন ছাড়করণের পরিমাণ ১৯১ কোটি ৯১ লাখ ৯০ হাজার ডলার। এর পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিশ্বব্যাংক। বহুপক্ষীয় সংস্থা হিসেবে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সহায়তা ছাড়করণ হয়েছে ১৫৭ কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার। তৃতীয় সর্বোচ্চ এডিবির সহায়তা ছাড়করণ হয়েছে ১২৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। চতুর্থ শীর্ষ দেশ হিসেবে এখন রাশিয়ার সহায়তার পরিমাণ ৯০ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং পঞ্চম শীর্ষ দেশ চীন থেকে ছাড়করণ হয়েছে ৫৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার। মূলত দেশের বৃহৎ কয়েকটি অবকাঠামোতে দেশ দুটির অর্থায়ন এবং সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্য সরকারের বাংলাদেশে অর্থায়ন অনুদান সহায়তা কমে যাওয়ার কারণে পরিবর্তন আসছে।

জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হবে লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯২ লাখ টাকা। মেয়াদকাল ধরা হয়েছে জুলাই ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে সরকারিভাবে মাত্র ২২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা দেয়া হবে। আর রাশিয়া থেকে বৈদেশিক ঋণ হিসেবে সহায়তা নেয়া হবে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের এডিপিতে মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ প্রকল্পে। যার পরিমাণ ৫৮ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রাশিয়া ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিশন অন ট্রেড ইকোনমিক, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন বৈঠকে বেশকিছু সিদ্ধান্ত এসেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিশেষ করে সিদ্ধিরগঞ্জ ঘোড়াশালে চলমান দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উন্নয়নে জড়িত রাশিয়া। বিদ্যুতের পাশাপাশি জ্বালানি বিমান পরিবহন খাতে সহযোগিতা করবে দেশটি। পাশাপাশি রাশিয়ার নবটেক কোম্পানি স্বল্প সুদে এলএনজি আমদানির সুযোগ দেবে বলে একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন।

এছাড়া পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে জি-টু-জির মাধ্যমে ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে চীন। সরকারিভাবে অর্থায়ন করা হবে ১৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা। তবে নতুন করে কাজ শেষ করতে আরো দেড় বছর সময় চাওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি হাজার ১৭৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়তে পারে। অন্যদিকে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পে হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন। ফলে সামনের দিনে দ্বিপক্ষীয়ভাবে দুটি দেশের সঙ্গে বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ আরো বাড়বে। কেননা দেশ দুটির সঙ্গে বড় ধরনের ঋণ প্রস্তাব রয়েছে। এজন্য রাশিয়া চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ঋণ প্রস্তাব প্রতি বছরই বাড়ছে।

ইআরডি বলছে, বিনিয়োগের চাহিদা মেটাতে বিদেশী সহায়তা বাড়ানো কার্যকর ব্যবহারে মনোযোগী হচ্ছে ইআরডি। বাজেটে বাংলাদেশের মোট সরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির দশমিক শতাংশ। সরকারের বাজেট ঘাটতি ছিল জিডিপির . শতাংশ। এটি নেট বৈদেশিক সহায়তার মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে। স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, পরিবহন, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষাসহ সামাজিক খাতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য ইআরডি উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক সহায়তা সংগ্রহ করার জন্য চেষ্টা করছে। যেহেতু কভিড-১৯ চলমান সেজন্য বাজেট সহায়তা ছাড়াও ভ্যাকসিন সহায়তা এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য প্রকল্প সহায়তার বাইরে অতিরিক্ত বৈদেশিক সহায়তা সংগ্রহের জন্যও বিশেষ মনোযোগ দেয়া হচ্ছে।

সব মিলিয়ে গত কয়েক বছরের ব্যবধানে রাশিয়া চীনের সহায়তার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। ফলে গত ৫০ বছরের তালিকায় শীর্ষ চারে উঠে এসেছে রাশিয়া। এছাড়া পঞ্চম স্থানে থাকা ইউএন সিস্টেমের পরেই শীর্ষ ছয় নম্বরে এখন চীন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী কয়েক বছরে চীন থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক সহায়তা ছাড়করণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে তাতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শীর্ষ পাঁচে উঠে আসবে চীন।

১৯৭১-৭২ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের আইডিএ সহায়তা এসেছে হাজার ৪৯৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। এর পরেই এডিবির সহায়তার পরিমাণ হাজার ৭৫৯ কোটি ২৫ লাখ ডলার এবং জাপানের বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ হাজার ৬১৮ কোটি ৯২ লাখ ডলার। অন্যদিকে রাশিয়ার ৪৪৪ কোটি ২০ লাখ, ইউএন সিস্টেমের মাধ্যমে ৪১৮ কোটি ৫৯ লাখ এবং চীনের বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ ৩৭৪ কোটি ১০ লাখ ডলার।

জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশী সহায়তার মোট বিতরণের পরিমাণ ছিল ৭২১ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এর মধ্যে অনুদান ৪৩ কোটি ৯৬ হাজার ডলার এবং ঋণের পরিমাণ ৬৭৮ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার ডলার। গত পাঁচ অর্থবছর বা ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রতিশ্রুতির পরিমাণ হাজার ১৯৯ কোটি ডলার। প্রতি বছর গড়ে হাজার ২৩৯ কোটি ডলার। এই পাঁচ অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তা এসেছে হাজার ১৫৬ কোটি ডলার। প্রতি বছর গড়ে যা ৬৩০ কোটি ডলার।

মূলত স্বল্প আয়ের দেশের তালিকায় থাকার কারণেই সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশে বিশ্বব্যাংকের আইডিএ ঋণ পাওয়া গেছে। কিন্তু নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উন্নীত হয়ে গেলে ভবিষ্যতে শতাংশের কাছাকাছি সুদের হারে ঋণ নিতে হবে। এছাড়া ম্যাচুরিটির সময় ৩৮-৪০ বছর থেকে ৩০ বছরে নেমে আসবে। গ্রেস পিরিয়ডও ১০- বছর থেকে নেমে বছরে স্থির হবে। জাপানের ক্ষেত্রেও ম্যাচুরিটির সময় ৪০ বছর থেকে নেমে ৩০ বছরে এবং গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর থেকে বছরে নেমে আসবে। আর সুদের হার শূন্য দশমিক শূন্য শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশে উন্নীত হবে। শুধু এডিবির সুদের হার সময়গুলো ঠিক থাকবে।  তাই ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে এখন থেকেই কৌশলী হতে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডির) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক . মুস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের উন্নয়নে প্রয়োজনীয়তার নিরিখেই রাশিয়া চীন থেকে সহায়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মাধ্যমে ঋণ চাহিদা বৈদেশিক সহায়তা ছাড়করণের ক্ষেত্রে একটি বৈচিত্র্য এসেছে। এছাড়া রাশিয়া চীনের সহায়তা দেয়ার সক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক ভালো। ফলে দেশ দুটি থেকে অর্থায়নের নির্ভরতা বাড়ছে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই ঋণ সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বিশেষ করে গ্রেস পিরিয়ড ম্যাচুরিটির সময়, সুদের হার, শর্ত ভালোভাবে দেখে নিতে হবে। বৈদেশিক সহায়তা সঠিকভাবে সমন্বয় করতে না পারলে তা দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

তিনি আরো বলেন, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রাধিকার খাত ঠিক করতে না পারা, প্রকল্পের ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে না পারলে এসব অবকাঠামো থেকে ভবিষ্যতে আয় (আইআরআর) কমে যাবে। ফলে বৈদেশিক ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে কৌশলী হতে হবে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে বৈচিত্র্যের কথা বললেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক . শামসুল আলমও। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, দেশ দুটি থেকে বৈদেশিক সহায়তা নেয়ার মাধ্যমে ঋণ গ্রহণে এখন আমরা আরো বেশি দরকষাকষি করতে পারছি। কেউ আমাদের ওপর আর শর্ত চাপিয়ে দিতে পারবে না। রাশিয়া চীনের সক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের ওপর আস্থাও এসেছে। সে কারণেই তারা ঋণ দিচ্ছে অর্থায়ন করছে। এটি অর্থনৈতিক বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ। বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের আরো আর্থিক বাজেট সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু ঋণের দায় এখনো অনেক কম ফলে স্বল্প সুদের এবং তুলনামলক কম শর্তারোপের বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে অবকাঠামো, প্রযুক্তি উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করার সুযোগ রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন