অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও সরকারি সংস্থার সমন্বয়হীনতা

পুরান ঢাকার অবকাঠামোগত পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ

আল ফাতাহ মামুন

নাগরিক জনভোগান্তিরও বড় জায়গা হয়ে উঠেছে পুরান ঢাকা। দিন-রাত যানজট লেগেই থাকছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ী ও পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক শিল্প ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা। রাস্তা প্রশস্ত করাসহ ঘিঞ্জি জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটির নতুন করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে জনভোগান্তি দূর করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে ছবি: মো. মানিক

বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী নগরী হিসেবে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়েই পত্তন হয়েছিল ঢাকার। নৌপথে পণ্য পরিবহনের সুযোগ ঢাকার নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোকে গড়ে তুলেছিল বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে। ব্রিটিশ আমলে বাংলার রাজধানীর মর্যাদা হারালেও হারায়নি নগরীর বাণিজ্যিক আবহ। পুরান ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকাগুলো সে আবহ নিয়ে টিকে রয়েছে এখনো। কিন্তু গত এক শতকের অপরিকল্পিত নগরায়ণ সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যকার সমন্বয়হীনতা পুরান ঢাকার অবকাঠামোগত পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে বাড়িয়েছে স্থানীয়দের জনভোগান্তিও।

ঢাকার সদরঘাট এখনো দেশের বৃহত্তম নদীবন্দর। দেশের বৃহত্তম কাপড়ের বাজার ইসলামপুর, স্বর্ণের বাজার তাঁতীবাজার, বৃহত্তম শস্যবাজার শ্যামবাজার ফলের বাজার বাদামতলী ঘাট ঢাকার বাণিজ্যিক ঐতিহ্যেরই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে এখনো। দেশের প্রকাশনা শিল্পের আঁতুড়ঘর বাংলাবাজারও এখানে। দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার চকবাজার। রয়েছে ঐতিহ্যবাহী অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জেলা প্রশাসন আদালতসহ বেশকিছু প্রশাসনিক স্থাপনাও রয়েছে এখানে।

কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে আবার নাগরিক জনভোগান্তিরও বড় জায়গা হয়ে উঠেছে পুরান ঢাকা। দিন-রাত যানজট লেগেই থাকছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ী পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক শিল্প ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা। বিষয়ে ইসলামপুর চকবাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, দেশের ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ বিপণি বিতান হওয়ায় এখানে তারা ব্যবসা ধরে রেখেছেন। কিন্তু ট্রাফিক জ্যাম অপ্রতুল অবকাঠামোর কারণে তাদের মারাত্মক ব্যবসায়িক ক্ষতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

কিন্তু রাস্তা প্রশস্ত করাসহ ঘিঞ্জি জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটির নতুন করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে জনভোগান্তি দূর করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এজন্য নগর পরিকল্পনাবিদরা দায়ী করছেন অপরিকল্পিত নগরায়ণ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, পুরান ঢাকার জনভোগান্তি লাঘবের কোনো উদ্যোগই নেয়নি দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ। বরং পুরান ঢাকার ভোগান্তিকে পুষে রাখা হয়েছে। চাইলেই এখানে পরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো গড়ে তুলে একটি সুন্দর নগরী গড়া সম্ভব ছিল। কিন্তু এত বছরেও কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজে হাত দেয়নি।

তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে বহু বলাবলির পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় স্থানান্তর করা হচ্ছে। পুরান ঢাকার সদরঘাটকে যদি স্থানান্তর করে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হতো, তাহলে এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তি অনেকটাই কমে যেত। যদিও সদরঘাট স্থানান্তরিতই একমাত্র সমাধান নয়। তবে সদরঘাট সহজে স্থানান্তরযোগ্য। সদরঘাট স্থানান্তর করা হলে বুড়িগঙ্গা নদীও বেঁচে যেত। সবাই মিলে যার যার পক্ষ থেকে সহযোগিতা করলে এতদিনে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা একটি বাসযোগ্য নগরী পেয়ে যেতেন।

তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সঙ্গে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, পুরান ঢাকার জনভোগান্তিতে ঢাকা নদীবন্দর তথা সদরঘাটের বড় একটি ভূমিকা আছে। এটা অস্বীকার করা যায় না। তবে এককভাবে কাউকেই দায়ী করা ঠিক হবে না। সিটি করপোরেশন যদি প্রশস্ত রাস্তাঘাট নির্মাণ করে দিত, তাহলে কিন্তু এখানে কোনো যানজট দুর্ভোগ থাকত না। আবার ঢাকা জেলা প্রশাসক যদি তার জায়গা থেকে ভূমিকা নিতেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জেলখানা স্থানান্তরের পাশাপাশি যদি জেলা আদালতকেও এলাকা থেকে সরিয়ে নিত, তাহলে এলাকার মানুষ অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারত।

রাজধানী হিসেবে বয়স ৪০০ হলেও জনবসতি হিসেবে ঢাকার বয়স ৮০০ বছরেরও বেশি। পৃথিবীর অন্যসব সমৃদ্ধ নগরীর মতোই ঢাকাও গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। নৌপথের জৌলুসের দিনে ১৬১০ সালে ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন সুবেদার ইসলাম খান। এরপর বিভিন্ন বণিক সম্প্রদায় ঢাকায় এসে বসতি গড়েছেন বাণিজ্যিক কারণে। আরো বেশ কয়েকটি নদীর সংযুক্তি ছাড়াও ঢাকায় শতাধিক খালের উপস্থিতির তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গাসহ ছয়টি নদী দখল-দূষণে বিপর্যস্ত অবস্থায় টিকে থাকলেও বেশির ভাগ খাল হারিয়ে গিয়েছে।

পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ঘিঞ্জি হয়ে পড়ায় এখানকার অনেকেই ঢাকার তুলনামূলক নতুন জায়গাগুলোয় স্থানান্তরিত হয়েছেন।  এলাকা নিয়ে বড় আকারের কোনো পরিকল্পনাও দেখা যায় না। বছরের পর বছর ভোগান্তি মাথায় নিয়ে চললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো দুর্ভোগ কমানোর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

নগর উন্নয়নের মূল দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) খোদ রাজউকই বলছে, আপাতত পুরান ঢাকার মানুষের ভাগ্যে সুদিন আসছে না। সংস্থাটির চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বিষয় বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতিটি উন্নত শহরেরই পুরান শহর রয়েছে। দিল্লিতে পুরান দিল্লি রয়েছে। কলকাতায়ও পুরান কলকাতা রয়েছে। তেমনি ঢাকায়ও রয়েছে পুরান ঢাকা। এখানে যারা অপরিকল্পিতভাবে বসতি গড়েছে, তাদের হুট করে সরিয়ে দেয়া যাবে না। পুরান ঢাকা আমাদের একটি বাণিজ্যিক হাব। এটিকে হঠাৎ করে বদলানো যাবে না। তবে রাজউক এখন সার্বিকভাবে নগর উন্নয়নের জন্য ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) নিয়ে এগোচ্ছে।

পুরান ঢাকার জনভোগান্তি যে অচিরেই কমছে না, তেমনটি ইঙ্গিত দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী পরিচালক ফরিদ আহাম্মদও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এখানকার এলাকাগুলো অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠেছে। এখানে জনভোগান্তি আছে। তবে আপাতত এখানে রাস্তাঘাট নির্মাণ বা প্রশস্ত করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, আমরা বৃহৎ আকারে চেষ্টা করছি বুড়িগঙ্গার পাশের রাস্তাটিকে ছয় লেন বানাতে। এবং দখল হয়ে যাওয়া ফুটপাত দখলমুক্ত করতে। তাহলে ওই এলাকার ভোগান্তি অনেকটা কমে আসবে। তবে পরিকল্পনাটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি পাস করিয়ে আনতে এবং বাস্তবায়ন করতে বেশ সময় লাগবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন