সাংস্কৃতিক
সহাবস্থানের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়া একটি অনন্য ক্ষেত্র। এর দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাই, ভারতীয় সভ্যতার বৈচিত্র্যময় উপাদান সামাজিক ও ধর্মীয় বন্ধনের এক অনন্য নজির। ধর্মীয় বিভাজন সত্ত্বেও সবার সৌহার্দ্যপূর্ণ সামাজিক অবস্থান একে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত অবস্থানের কারণে এটি বিভিন্ন সময়ে বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। একটি কার্যকর শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সঠিক রূপায়ণ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন স্তরের সম্পর্ক এবং সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সামনে এগিয়ে যাওয়া এখন সময়ের দাবি।
ঠিক
এই জায়গায় এসে বাংলাদেশ ও ভারত এক মেলবন্ধনে আবদ্ধ। এ সম্পর্ক কোনো রূপায়িত ব্যাপার নয় বরং এটি জন্মগত। চারদিকে জলাধারে পরিপূর্ণ এ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ওয়েস্টফালিয়ান-পরবর্তী প্রজাতন্ত্র হিসেবে বহু শতাব্দী ধরে বিচিত্র জাতিসত্তার ধারক ও বাহক। এদিক থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বহুমুখী ও একই রাজনৈতিক ইতিহাস,
যা সাংস্কৃতিক অভিন্নতা এবং অর্থনৈতিক পরিপূরকতায় গভীরভাবে সম্পর্কিত। ১৯৭১-এর গৌরবময় সংগ্রামের পর থেকেই দুদেশের মনস্তাত্ত্বিক এ বন্ধন দিন দিন আরো গাঢ় হচ্ছে। যদিও ভারতের অনেকেই জানেন না, বাংলাদেশ সর্বদাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার ও জনগণ, বিশেষ করে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং এর সদস্যদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। ১৯৭১ সালের সংগ্রাম-পরবর্তী শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং প্রতিবেশী হিসেবে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার মানদণ্ড স্থাপন করেছে।
প্রায়ই
আমাদের এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যে ভারত-বাংলাদেশ ইতিহাস এবং ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে সমকালীন হলেও ঠিক কোন অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিভাজন আমাদের সামনে এ প্রশ্ন নিয়ে আনে। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে আমরা এ সম্পর্কের সঠিক মাত্রা নির্ধারণ করতে সক্ষম হব। (মামুন, ২০১৫)। ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমাদের আর্থসামাজিক নির্ণায়কগুলোর ক্রমাগত পরিবর্তন থেকেই এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
উভয়
দেশেই তুলনামূলক ক্রমবর্ধমান তরুণ জনসংখ্যা রয়েছে। এটি জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের যুগ অতিক্রম করছে বলে ধরে নেয়া যায়। উভয় দেশেই ব্যাপক এবং কঠোর দারিদ্র্য রয়েছে যারা আয় বৈষম্যের শিকার এবং সেই সঙ্গে স্বাক্ষরতা এবং জ্ঞানের ধীর প্রসার ঘটছে; এবং উভয় দেশের কিছু অংশ আক্রমণাত্মক ধর্মীয় মৌলবাদের অস্তিত্ব রয়েছে। একই সময়ে, দুটি দেশেই কর্মসংস্থান এবং সমৃদ্ধিশালী একটি বুর্জোয়া সম্প্রদায় আছে। মজার বিষয় হলো, উভয় দেশের মানুষেরই একটি উচ্চাভিলাষী মানসিকতা রয়েছে। এ মানসিকতা শুধু খাবার টেবিলে রেখেই সীমাবদ্ধ নয় বরং মঙ্গলে নভোযান পাঠানোর মতো সুদূরপ্রসারী।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুদেশের মধ্যে নিবিড় এবং গতিশীল আন্তঃসংযোগ নিশ্চিত করতে পারস্পরিক সম্পর্ককে বিপদের মুখে ফেলা যাবে না। এ অঞ্চল বিশ্বের অন্তত তিনটি প্রধান মিষ্টি জলের নদী ব্যবস্থা—তাদের উপনদী এবং শাখা, পলিসমৃদ্ধ ব-দ্বীপ, বিস্তীর্ণ জলাভূমি, একটি সম্ভাবনাময় সমুদ্র দুটি দেশ ভাগ করে নিয়েছে। দুদেশের মধ্যে সম্পর্কে প্রথম ছেদ ঘটান র্যাডক্লিফ। তিনি এমনসব এলাকাকে বিভক্ত করেন যে এলাকাগুলোতে তিনি একবারও যাননি।
পরবর্তী
সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্বাক্ষরিত ১৯৭৪ সালের চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে মাত্র ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার এখনো অনির্ধারিত রয়ে গেছে। পৃথকভাবে তিনটি জায়গায় এ সীমানা আছে যার কোনোটিই ৩ কিলোমিটারের বেশি নয়। ছিটমহল
বিনিময়ের
প্রশ্ন (বাংলাদেশে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল যার আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮ দশমিক ১৩ একর; ভারতীয় ভূখণ্ডে ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল যার আয়তন ৭ হাজার ১১০ দশমিক ২ একর) এবং দখলে থাকা অঞ্চলগুলো (বাংলাদেশের ৩ হাজার ৫০৬ দশমিক ১ একর জায়গা ছিল ভারত এবং ৩ হাজার ০২৪ দশমিক ১৬ একর ভারতীয় ভূখণ্ড বাংলাদেশের প্রতিকূল দখলে)। শুধু পদ্ধতিগত বিলম্বের কারণে এখন পর্যন্ত দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক বিপর্যস্ত।
এমনকি
যখন কারিগরি কমিটিগুলো প্রায় ১ হাজার ২০০ স্ট্রিপ-ম্যাপ স্বাক্ষর করেছিল এবং ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি কার্যকরভাবে মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছিল, তখনও সংসদে ঐকমত্যের অভাবের জন্য বিষয়টি ঝুলে ছিল। বাস্তবিক এ বাধাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। ছিটমহল এবং প্রতিকূল দখলে থাকা জমির বাসিন্দাদের মানবেতর জীবন কেবল একটি সমস্যাই ছিল না, বরং এটি দুটি দেশের জন্য লজ্জার বিষয়। বাংলাদেশ সত্তরের দশকের শুরুতেই এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিটি অনুমোদন করেছিল। ছিটমহল, প্রতিকূল দখলকৃত জমি এবং অনির্ধারিত সীমানা নামক এ অদ্ভুত সমস্যা আক্ষরিক অর্থেই একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বিচারিক চুক্তির অভাব উভয় দেশের মানুষের সম্পর্কোন্নয়নে একটি বিরাট বাধা। এটি দুদেশেরই নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়কে নির্দেশ করে। যদিও ভারতে প্রতিটি সরকার সাংবিধানিক সংশোধনী বিল পাস করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছে, তবে এর জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদিকে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেয়া যেতে পারে।
একটি
এলাকা যা তিন দশকেরও বেশি সময় বিপরীত দেশের পরিচয় বহন করছিল এটি যেকোনো দেশের জন্যই নিরাপত্তাঝুঁকি। বিশেষ করে স্বায়ত্তশাসিত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উত্থান ঘটে এখান থেকেই। গত ১২ বছরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে, একে অপরের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘনকারী সব গোষ্ঠীকে চাপে রাখার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো উলফার মতো উত্তর-পূর্ব বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে বাংলাদেশের সহযোগিতা। দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আন্তরিক সহযোগিতা একে অপরের প্রতি বিভ্রান্তি দূর করে পারস্পরিক সম্পর্ককে গতিশীল করেছে।
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা ১২ বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর থেকে, তার সরকার দুদেশের মধ্যে সম্পর্ককে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য একটি বাস্তবভিত্তিক কর্মকৌশল তৈরি করেছেন। দ্বিপক্ষীয় হোক বা আঞ্চলিক পর্যায়ে এসব কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিল এ অঞ্চলের জন্য সামগ্রিকভাবে টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা করা।
বাংলাদেশ:
দক্ষিণ এশিয়ায়
সহাবস্থানের এক
দৃষ্টান্ত
প্রতিবেশী
দেশগুলোর সঙ্গে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক মূলত তাদের সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করে। নিজ দেশের জনগণ ছাড়াও প্রতিবেশর দোরগোড়ায় এ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
প্রথমত, অর্থনৈতিক সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে বাজার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পণ্য এবং পরিষেবা উভয় ক্ষেত্রেই পরিবেশগতভাবে টেকসই আঞ্চলিক রফতানির দ্রুত সম্প্রসারণ করতে হবে। অতীতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাজার পুনর্গঠনে কার্যকর পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। তৃতীয়ত, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা জোরদার করা, চতুর্থত, আঞ্চলিক অর্থনীতিতে পেশাদার এবং শ্রমিক উভয়েরই বিস্তৃত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে অর্থনীতির বোঝা হ্রাস করা। পঞ্চম, আঞ্চলিক শক্তি বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ গ্রহণ, ষষ্ঠ, নীতি প্রণয়নসংক্রান্ত আলোচনায় তরুণ, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অন্তর্ভুক্ত করা।
দুই
দেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করার বিভিন্ন কারণ হলো ভৌগোলিক নৈকট্য, সাধারণ ভাষা, অনুরূপ জনসংখ্যা এবং ভোগের ধরন, সাধারণ উন্নয়নের চাহিদা এবং অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে, গ্র্যাভিটি মডেলে এগুলো অত্যন্ত উচ্চ ইতিবাচক প্রভাবক, যা যেকোনো দুটি দেশ এবং তাদের অর্থনীতিকে খুব কাছাকাছি নিয়ে আসবে, যেন তারা প্রায় এক হলেও প্রত্যেকে তার সার্বভৌম অগ্রাধিকার বজায় রাখে।
ভূ-রাজনৈতিক বা বরং ভূ-কৌশলগত স্বার্থ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের অবস্থানের একটি স্বাভাবিক ফল, তা খর্ব করা যাবে না। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সপ্তম শতাব্দীতে যখন হিউয়েন সাং ভারতে ভ্রমণ করেছিলেন, বাংলা এবং বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ সর্বদাই ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার। এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র। মহাভারত থেকে মেগাস্থেনিসের ‘ইন্ডিকা’ প্রতিটি গ্রন্থই এ কথার সত্যতা প্রমাণ করে।
যদিও
আজকের দক্ষিণ এশিয়ায় সামাজিক নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ই শান্তিপূর্ণ আশু প্রতিবেশীর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত আছে। জাতীয় নিরাপত্তা, শাসন ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা বাংলাদেশ এবং ভারতীয় নীতিনির্ধারক বিষয়ে উভয় পক্ষেরই ভালো বোঝাপড়া আছে। শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও প্রতিশ্রুতি এ সম্পর্ককে আরো নিশ্চয়তা দিয়েছে। দেশকে ভারতবিরোধী উপাদান থেকে মুক্ত করা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে আসছে। সর্বোপরি, বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদ উভয় দেশেরই অভিন্ন শত্রু। বাংলাদেশ ভারতের মূল ভূখণ্ড এবং উত্তর-পূর্বের মধ্যে কয়েক দশকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য শিল্প ব্যবহারের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এবং বিভিন্ন পয়েন্টের মধ্যে বৃহত্তর সংযোগ স্থাপনের সুবিধার্থে কাজ চলছে।
এশিয়া
মহাদেশের জলসীমার ওপর বহির্বিশ্বের আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে দুটি দেশই তাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে নিয়েছে। এটা মনে রাখা দরকার, ভারতে এরই মধ্যে পরমাণু শক্তিধর তিনটি পরাশক্তি রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের জলসীমার সফল বিভাজন ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এখন খুবই প্রাসঙ্গিক। সমুদ্রকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার এখনই উপযুক্ত সময়।
এটা
বলা হয়, একটি দৃষ্টিভঙ্গি অতীতের সত্য, বর্তমানের উপলব্ধি এবং ভবিষ্যতের জন্য ধারণা থেকে গড়ে ওঠে। আমরা অতীতকে স্পষ্টভাবে দেখেছি এবং বর্তমানকে অনুভব করছি। উভয় পক্ষের দূরদর্শী চিন্তাবিদরা কাজ শুরু করার জন্য কয়েকটি নতুন ক্ষেত্রের কথা বলছেন। এর মধ্যে রয়েছে, প্রথমত শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ আন্তর্জাতিক সীমান্ত এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, দ্বিতীয়ত, নদী অববাহিকায় পানিনিরাপত্তা এবং যৌথ ব্যবস্থাপনা। তৃতীয়ত, শক্তি নিরাপত্তা এবং আন্তঃসীমান্ত উৎপাদন এবং বিদ্যুৎ বাণিজ্য, চতুর্থত, অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহারের ওপর বিশেষ জোর দেয়া, পঞ্চমত, উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক উন্নয়ন এবং মেগা-স্থাপত্যের ব্যবহার যেমন আঞ্চলিক ও মহাদেশীয় মহাসড়ক, রেল নেটওয়ার্ক, সমুদ্রবন্দর এবং উপকূলীয় শিপিং, ষষ্ঠ, বিনিয়োগ, উৎপাদন ও সেবা খাতের পরিপূরকতা, সপ্তম, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন এবং রোগ, অপুষ্টি, অশিক্ষা ও অজ্ঞতা দূরীকরণ, অষ্টম, উদ্ভাবনী এবং উচ্চ মূল্যসংযোজন পণ্য এবং পরিষেবা উভয়ের যৌথ অর্থায়ন এবং বিপণনে টেকসই ডিজাইন তৈরি করা এবং নবম, পরিমাপযোগ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে নেতৃত্বের বিকাশ।
এছাড়া
প্রাচীন মূল্যভিত্তিক উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগের নেটওয়ার্কগুলোকে নতুন করে প্রাইভেট লেভেলে পরিচালনা করার সুযোগ চলে এসেছে। আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বিশ্ববিদ্যালয় এবং দক্ষতা-নির্মাণ কেন্দ্র, হাসপাতাল এবং আতিথেয়তা পরিষেবা যুক্ত করা হয়েছে।
এটা
জরুরি যে আমরা শুধু আমাদের দুদেশের জন্য নীতি ও বিধি প্রণয়ন করি না, তবে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য আমরা সেগুলোকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করি।
বাংলাদেশ-ভারত: পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়ন
টেকসই
উন্নয়নের স্বার্থে, অভিন্ন নদী পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া গুরুত্বপূর্ণ কারণ এ ধরনের ঘটনা জনমতকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে। নীতিনির্ধারকদের উচিত, তিস্তার পানিবণ্টনের চুক্তিতে স্বাক্ষর করা ত্বরান্বিত করা। এ নদীটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সেচের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করছে। প্রকৃতি, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির দ্বারা আবদ্ধ দুটি দেশকে সহযোগিতার মাধ্যমে নতুন ক্ষেত্রগুলোতে এগিয়ে আসা উচিত। এ অঞ্চলের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে শুধু যোগাযোগের মাধ্যমেই নয় বরং সংস্কৃতি এবং জনগণের মধ্যে সংযোগের ক্ষেত্রেও হওয়া উচিত। দুদেশের রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই সীমানার বাইরে দেখতে হবে এবং একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং প্রগতিশীল অঞ্চলের জন্য একটি প্রগতিশীল অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে।
এখন
পর্যন্ত বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্ভাবনার তুলনায় অনেক কম। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, যার একটি বড় অংশ স্থলবকন্দরের মাধ্যমে সংঘটিত হয় তা কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এক্ষেত্রে ব্যয় যেমন বেশি তেমনি দীর্ঘসূত্রতার মতো সমস্যা পাশাপাশি লজিস্টিক অসুবিধা বিদ্যমান। এটি দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করে। প্রকৃতপক্ষে, যে কিছু পণ্যের জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যয় ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যের তুলনায় বেশি। ভারত বিশ্ববাজার থেকে বছরে প্রায় ৪৫০ দশমিক শূন্য বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করলেও ভারতে বাংলাদেশের রফতানি মাত্র ১ দশমিক শূন্য বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।
এ
পটভূমিতে চলমান অর্থনৈতিক নীতির প্রয়াস এবং নীতি পরিবর্তনগুলো সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসা দরকার। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে আরো সম্প্রসারিত করে পণ্য, পরিষেবা এবং জ্বালানি বাণিজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত করা প্রয়োজন। অবকাঠামো নির্মাণ, আন্তঃসীমান্ত বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, যার অনেকগুলো ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ভারত প্রদত্ত লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) দ্বারা অর্থায়ন করা হচ্ছে। ভারত থেকে শক্তি আমদানি, বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের সম্পৃক্ততা, পদ্মা সেতুর জন্য প্রদত্ত অনুদান, বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ, উপকূলীয় সহযোগিতা জোরদার, বাংলাদেশের মংলা, চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের মাধ্যমে নেপাল ও ভুটানে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান; বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটর ভেহিকেল চুক্তি স্বাক্ষর এবং অন্যান্য উদ্যোগ এ মুহূর্তে ব্যবসা, ব্যবসা এবং সংযোগের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেভাবে কাজ করে তাতে পরিবর্তনের সাগরের সূচনা করতে পারে। বাংলাদেশ এগুলোকে এমন সুযোগ বলে মনে করে যা প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে দেশকে এগিয়ে রাখে। নদী, রেল, রাস্তা, বিমান চলাচল এবং শিপিং নেটওয়ার্কগুলোকে ভারতের সঙ্গে একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সংযুক্ত করা প্রয়োজন যাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সংযোগ বাধাহীন থাকে।
আমি
আমাদের দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিক বিবর্তন নির্দেশ করার সাহস করব না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এ সময় আমরা একটি মহান স্বপ্ন তৈরি করব, যা আমরা ভাগাভাগি করে নিতে পারি। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আমরা একটি ভিশন ডকুমেন্ট এক করব, যা মূল অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রাকে নির্ধারণ করে দুই দেশের মধ্যে সহাবস্থান, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। উদ্ভাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে দুদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব বিশ্বের দরবারে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এর
জন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, সাহসী নেতৃত্ব এবং শক্তিশালী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম। যদি আমরা দক্ষিণে সমুদ্রের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য গ্রেট ট্রান্স-এশিয়ান রেল রোড রিভার নেটওয়ার্কের ধারণা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাই এটি এ অঞ্চলের জন্য এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের উদ্যোগগুলোকে উন্নয়নের অর্থ পুনরায় ঢেলে সাজানো উচিত। পশ্চিমা নীতির বাইরে এসে সার্বজনীন অবস্থান থেকে, আমাদের নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে তা বাস্তবায়ন করা উচিত। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, অর্থনীতির উন্নয়ন আসে সংস্কৃতি থেকে, পশ্চিমা অধীনতা কিংবা উপনিবেশবাদের উপজাত হিসেবে নয়। আমরা যদি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিকল্পনা করতে পারি, তাহলে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের উদাহরণগুলোকে ‘দ্বিপাক্ষিকতা এবং তার বাইরে’ উদাহরণ হিসবে সবার কাছে উপস্থাপন করা যাবে।
ড.
এ কে
আব্দুল মোমেন: সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তর: হাসান তানভীর